ঢাকা, বুধবার, ২ বৈশাখ ১৪৩২, ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

বর্ষবরণের আনন্দ শোভাযাত্রায় ‘৩৬ জুলাই’

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০২৫
বর্ষবরণের আনন্দ শোভাযাত্রায় ‘৩৬ জুলাই’

ঢাকা: বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে গত বছরের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত অন্তত দুই হাজার মানুষের মৃত্যু এবং ৩০ হাজার আহত হয়। ওই আন্দোলনের বিজয় আসে ৫ আগস্ট।

আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ ৫ আগস্টকে ৩৬ জুলাই হিসেবে অভিহিত করেছেন।

‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’ প্রতিপাদ্য নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এবারের ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’য় সেই আন্দোলনের স্মরণে বিশাল আকৃতির ‘৩৬ জুলাই’ মোটিফ প্রদর্শন করা হয়েছে।

পহেলা বৈশাখ সোমবার (১৪ এপ্রিল) সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খানের নেতৃত্বে এ শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।  

শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছেন সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।

বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের অংশগ্রহণে শোভাযাত্রা চারুকলা থেকে শুরু হয়ে শাহবাগ মোড় ঘুরে টিএসসি মোড়, শহীদ মিনার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র, দোয়েল চত্বর হয়ে পুনরায় চারুকলা অনুষদে গিয়ে শেষ হয়।

বৈষম্যের প্রতিবাদে গত বছরের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে ও তিনদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। এদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মিনারের সামনে অবস্থান নেয়। ২ থেকে ৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ, মানববন্ধন, মহাসড়ক অবরোধ ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে। ৭ জুলাই শিক্ষার্থীরা ‘বাংলা ব্লকেড’-এর ডাক দেয় যার আওতায় শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ সমাবেশ, মিছিল, মহাসড়ক অবরোধ ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে। এর ধারাবাহিকতায় আন্দোলন দমনে তৎকালীন সরকারের নিপীড়ন, নির্যাতন ও হত্যা চালিয়ে যেতে থাকে। সব শেষ ৫ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী দেশ থেকে পালিয়ে যান। সেদিনই জনগণ রাস্তায় নেমে বিজয় উল্লাস করে। অবসান হয় আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরে শাসনের।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছে, এবারের শোভাযাত্রায় ২৮টি জাতিগোষ্ঠী, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন দেশের অতিথি অংশ নিয়েছেন। এ বছর প্রধান ৭টি মোটিফ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে দীর্ঘসময়ের ফ্যাসিবাদী শাসনের চিত্র তুলে ধরতে ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ মোটিফ ছিল।  

বাঁশের বেত-কাঠ দিয়ে মুখাকৃতিটি তৈরির পর শনিবার (১২ এপ্রিল) ভোরে এক দুর্বৃত্ত এটি জ্বালিয়ে দেয়। পরে কর্কশিটের ওপর পুনরায় এটি তৈরি করা হয়।

এবারের শোভাযাত্রায় জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ আবু সাঈদের ‘প্রতীকী মোটিফ’ রাখার প্রাথমিক চিন্তা ছিল। তবে পরিবারের অনুরোধে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে প্রশাসন। আবু সাঈদের প্রসারিত দুইহাত না থাকলেও আনন্দ শোভাযাত্রায় স্থান পেয়েছে মুগ্ধের প্রতীকী পানির বোতল। এটি দ্বারা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জীবন দেওয়া শহীদদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।

এছাড়াও এবারের শোভাযাত্রায় বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক বাঘ, ইলিশ মাছ, শান্তির পায়রা ও পালকি রয়েছে। এ বছর ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মুসলমানদের লড়াই সংগ্রামের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে তরমুজের ফালি মোটিফ হিসেবে রাখা ছিল। তরমুজ ফিলিস্তিনিদের কাছে প্রতিরোধ ও অধ্যাবসায়ের প্রতীক হিসেবে পরিচিত।

বড় মোটিফের পাশাপাশি এ বছর মাঝারি মোটিফ রয়েছে ৭টি। এর মধ্যে সুলতানি ও মুঘল আমলের মুখোশ, রঙিন চরকি, তালপাতার সেপাই, তুহিন পাখি, পাখা, ঘোড়া ও লোকজ চিত্রাবলির ক্যানভাস ছিল।

এছাড়া ছোট মোটিফগুলোর মধ্যে ছিল ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি, বাঘের মাথা, পলো, মাছের চাই, মাথাল, লাঙল এবং মাছের ডোলা। এবারের শোভাযাত্রায় বিশেষ স্থান করে নিয়েছে বাংলার প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পটচিত্র। পট বা বস্ত্রের ওপর এই লোকচিত্র আঁকা হয়। চারুকলায় এবার ১০০ ফুট দীর্ঘ লোকজ চিত্রাবলির পটচিত্র আঁকা হয়েছে।

এবারের বর্ষবরণ অন্যবারের চেয়ে একটু আলাদা। গেল ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এটাই প্রথম বাংলা নববর্ষ উদযাপন। ফ্যাসিস্ট ও ফ্যাসিবাদমুক্ত বর্ষবরণ উৎসবে মাতোয়ারা দেশবাসী।

পটচিত্রে আকবর, বাংলাদেশের জাতীয় পশু বাঘ, বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সংগ্রাম ১৯৫২ ও ১৯৭১ এবং ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ আবু সাঈদ, বেহুলা লখিন্দর, বনবিবি এবং গাজীরপট আঁকা হয়েছে। প্রত্যেকটি চিত্রে উল্লেখযোগ্যভাবে বাঘ এবং বাঘের রং।

এর আগে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত সিসি ক্যামেরা ও আর্চওয়ে স্থাপনের ব্যবস্থা নেয় কর্তৃপক্ষ।

১৯৮৯ সালে চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে প্রথমবারের মতো বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা তবে ১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলার এই শোভাযাত্রা ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীতে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পায় এই শোভাযাত্রা। তবে এবার বর্ষবরণের 'মঙ্গল শোভাযাত্রা’র নাম বদলে রাখা হয় বর্ষবরণের ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০২৫
ইএস/এমএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।