ঢাকা, রবিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩২, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ২১ শাওয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

দিনাজপুরের ভবেশ রায়ের মৃত্যুর বিষয়ে যা জানাল পুলিশ

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০২৫
দিনাজপুরের ভবেশ রায়ের মৃত্যুর বিষয়ে যা জানাল পুলিশ

ঢাকা: দিনাজপুরে ভবেশ চন্দ্র রায় (৫৫) নামে এক কৃষকের মৃত্যু নিয়ে নানা আলোচনা তৈরি হয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভবেশকে  ‘হিন্দু নেতা’ উল্লেখ করে তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার বলে বিবৃতি পর্যন্ত দিয়ে বসেছে।

যদিও এটি হত্যাকাণ্ড কি না তা নিশ্চিত নয় তার পরিবার। এমনকি ভারতের ওই বিবৃতি প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশ।

রোববার (২০ এপ্রিল) বাংলাদেশ পুলিশের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ভবেশের মৃত্যুর ঘটনাটি নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছ, ভবেশ চন্দ্র রায় অত্যন্ত মিশুক প্রকৃতির একজন মানুষ বলে এলাকায় পরিচিত। একসময় ৯-১০ বিঘা জমিজমা থাকলেও বর্তমানে ভিটেমাটি ছাড়া তেমন কোনো সম্পদ নেই। তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। ভবেশ চন্দ্র রায়ের ছেলে স্বপন চন্দ্র রায় (২৮) স্নাতকোত্তর শেষে দিনাজপুর শহরের কালিতলা এলাকায় মেসে থেকে চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

ভবেশ চন্দ্র রায়ের স্ত্রীর ভাষ্য মতে, গত  বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) বিকেল সাড়ে ৫টায় প্রতিবেশী যুবক মো. রতন, আখতারুল ইসলাম আতিক (৪২), মো. রুবেল ইসলাম (২৫) ও মুন্না ইসলাম (২৭) দুটি মোটর সাইকেলযোগে ভবেশের বাড়িতে আসেন। তারা একসঙ্গে নাড়াবাড়ি হাটে যেতে বাড়ি থেকে বের হন। রতন, রুবেল ও আতিকদের বয়স ভবেশের বয়সের চেয়ে অন্তত ১৫-১৮ বছরের ছোট হলেও তারা নিয়মিত একসঙ্গে আড্ডা দেন, হাটে যান এবং ভবেশের বাড়িতে নিয়মিত যাওয়া-আসা করেন। ভবেশের শ্যালক ফুলবাবু, ছেলে স্বপন চন্দ্র এবং স্থানীয় ফুলবাড়ি হাটের অনেকের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি সম্পর্কে জানা যায়।  

বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) সন্ধ্যায় নাড়াবাড়ি বাজারের দুধ-হাটিতে রতন, আতিক, রুবেল, মুন্না ও ভবেশ চন্দ্র একসঙ্গে অহিদুলের চায়ের দোকানে চা পান করেন। চা পান কালে তারা স্বাভাবিক ছিলেন এবং তাদের মধ্যে কাউকে শারীরিকভাবে অসুস্থ মনে হয়নি। চা পান শেষে ভবেশ পাশের দোকান থেকে পান ও সিগারেট খান। কিছুক্ষণ পরে ভবেশ চন্দ্র হাটখোলার একটি ঘরের খুঁটিতে হেলান দেন। পরে মাথা ঘুরে সেখানে বসে পড়েন এবং প্রচণ্ড ঘামতে থাকেন। পান দোকানদার মতিবুর রহমানের (৫২) সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান; ভবেশ খয়ের, চুন ও কাঁচা সুপারি দিয়ে তার কাছ থেকে পান নিয়েছেন। পান খাওয়ার একপর্যায়ে ভবেশ পানের দোকানের সামনে হাটখোলার একটি ঘরের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে পড়েন। এসময় তার সঙ্গে থাকা কয়েকজনসহ স্থানীয়রা ধরাধরি করে পাশেই পল্লী চিকিৎসক লিটনের দোকানে নিয়ে যান ভবেশকে। স্থানীয়রা জানান, পল্লী চিকিৎসক প্রথমে তার প্রেসার মেপে দেখেন প্রেসার শূন্য হয়ে গেছে।

ভ্যানচালক সাদ্দাম হোসেন জানান, এশার নামাজের সময় পল্লী-চিকিৎসক লিটনের দোকান হতে রতন ও আতিকরা ভবেশকে তার ভ্যানগাড়িতে তুলে নাড়াবাড়ি বাজারের শেষ মাথায় পল্লী-চিকিৎসক আব্দুর রহমানের চেম্বারে নিয়ে গেলে সেখানে আব্দুর রহমানের ছেলে পল্লী চিকিৎসক সোহেল রানা (৩২) ভবেশের প্রেসার মাপেন। কিন্তু যন্ত্রে কোনো রিডিং না পাওয়ায় তিনি তাকে দ্রুত দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। এরই মধ্যে রতন ভবেশের ছেলে স্বপনকে ফোনকলে তার বাবার অসুস্থতার কথা জানান। মোবাইল ফোনে স্বপন রতনকে তার বাবাকে বাড়িতে রেখে আসার জন্য বলেন। নাড়াবাড়ি বাজার থেকে ফুলবাড়ি হাঁটের দূরত্ব প্রায় ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার। ভবেশের সঙ্গে থাকা রতন, আতিক, মুন্না ও রুবেল ভবেশসহ ওই একই ভ্যান গাড়িতে ফুলবাড়ি হাটে এসে পল্লী চিকিৎসক কৃষ্ণ চন্দ্রের দোকানে আবারও ভবেশকে দেখান। পল্লী চিকিৎসক কৃষ্ণ চন্দ্রও ভবেশের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে দ্রুত দিনাজপুর মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। রতন আবারও ভবেশের ছেলে স্বপনকে জানান, তার বাবা গুরুতর অসুস্থ, তিনি যেন শহর থেকে দ্রুত একটি অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে দেন।  

রাত সাড়ে ৮টার দিকে ভবেশের ছেলে স্বপন শহর থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ফুলবাড়ি হাঁটে আসেন। ততক্ষণে ভবেশের স্ত্রী ও শ্যালক সেখানে উপস্থিত হন। তারা অ্যাম্বুলেন্সে করে রাত ৯টা ১৮ মিনিটে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসক ইসিজি পরীক্ষা করে ভবেশকে মৃত ঘোষণা করলে তার আত্মীয়-স্বজন ভবেশের মরদেহ নিয়ে নিজ বাড়িতে চলে যান। রাত অনুমান ১১টা ৪৫ মিনিটে ভবেশের পরিবার থেকে বিরল থানা পুলিশকে বিষয়টি জানানো হয়। রাত সাড়ে ১২টায় পুলিশ বাসুদেবপুরে ভবেশের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে তার মরদেহের সুরতহাল কার্য সম্পন্ন করে।  

পুলিশ বলছে, ভবেশের শরীরের কোথাও কোনো মারপিট কিংবা আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তদুপরি পরিবারের সন্দেহের পরিপ্রেক্ষিতে বিরল থানা পুলিশ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে ভবেশের মরদেহ পোস্ট মর্টেমের জন্য দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। পরে ভবেশের পরিবার মর্গ থেকে মরদেহ গ্রহণ করে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করে। পোস্ট মর্টেম প্রতিবেদন অচিরেই পাওয়া যাবে। দিনাজপুর জেলা পুলিশ ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে নিবিড় তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।

এর আগে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘু নেতা ভবেশ চন্দ্র রায়ের অপহরণ ও নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক বার্তায় ভারতের এই বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, আমরা এই ভিত্তিহীন দাবিকে প্রত্যাখ্যান করছি। বাংলাদেশ এমন দেশ নয়, যেখানে সংখ্যালঘুরা সরকারের সমর্থনে কোনো বৈষম্যের শিকার হন। বাংলাদেশ সরকার সকল নাগরিককে তার ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে অধিকার রক্ষা করে।

তিনি বলেন, এই নির্দিষ্ট ঘটনায়, আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে ভুক্তভোগী পূর্বপরিচিত কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে বাইরে গিয়েছিলেন। তার পরিবার কারো সঙ্গে বাইরে যাওয়া নিয়ে কোনো সন্দেহজনক বিষয় জানাননি। ময়নাতদন্ত রিপোর্টে শরীরে কোনো দৃশ্যমান আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।

তবুও, মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত করতে ভিসেরা বিশ্লেষণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান এবং বলেন, ভিসেরা রিপোর্ট পাওয়ার পর উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

শফিকুল আলম আরও বলেন, আমরা সব পক্ষকে আহ্বান জানাচ্ছি, ঘটনাটি নিয়ে বিভ্রান্তিকর ও উসকানিমূলক মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকার জন্য।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০২৫
এজেডএস/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।