বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক মর্মান্তিক পরিণতির কারণে স্মরণীয় হয়ে আছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ছাত্র রুদ্র সেন। ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই, আন্দোলনের সময় পুলিশ ধাওয়া দিয়ে তাকে খালের পানিতে ফেলে দেয়।
দিনাজপুর সদর উপজেলার বাসিন্দা সুবীর সেন ও শিখা বণিক দম্পতির ছোট ছেলে ছিলেন রুদ্র সেন। শাবিপ্রবির কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড পলিমার সায়েন্স বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। বড় বোন সুস্মিতা সেন একজন ভেটেরিনারি চিকিৎসক।
একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে শোকে ভেঙে পড়েছেন রুদ্রের মা-বাবা। এখনো তারা বিশ্বাস করতে পারেন না, রুদ্র আর ফিরে আসবে না। রুদ্রের মৃত্যুর পর তার স্মৃতি বুকে নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে উঠেছে পরিবারটির জন্য। তাদের একমাত্র চাওয়া— ছেলের হত্যার বিচার। রুদ্রের পরিবারের বরাত দিয়ে এসব কথা বাংলানিউজকে জানিয়েছেন তার বন্ধু মো. হাফিজুল ইসলাম। তিনি রুদ্র হত্যা মামলার বাদিও।
হাফিজুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, রুদ্র দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। সে বেঁচে নেই, এটা মেনে নেওয়া কষ্টকর। তবে সে যে কারণে জীবন দিয়েছে, সেই আদর্শ বাস্তবায়ন হলেই তার আত্মা শান্তি পাবে।
পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কেউ ফোন রিসিভ করেননি। তবে হাফিজুল জানান, রুদ্রের বড় বোন সুস্মিতা আপার সঙ্গে আগে কথা হয়েছিল। তিনি খুবই গর্ববোধ করেন রুদ্রকে নিয়ে, যদিও এখন ফোন রিসিভ করছেন না।
২০২৪ সালের ১৯ আগস্ট, সিলেট অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন হাফিজুল ইসলাম। মামলায় ৭৬ জনের নাম উল্লেখ করে আরও অন্তত ৩০০ জনকে অজ্ঞাতনামাকে আসামি করা হয়। প্রধান আসামি সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের তৎকালীন উপ-পুলিশ কমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ। এছাড়া রয়েছেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. সাদেক দস্তগীর কাওসার, শাবির সাবেক ভিসি ফরিদ উদ্দীন আহমেদ, প্রো-ভিসি কবীর হোসেন, প্রক্টর কামরুজ্জামান চৌধুরী, সাবেক সংসদ সদস্য শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, রনজিত সরকারসহ অনেকে।
এজাহারে বলা হয়, পুলিশ, ছাত্রলীগ পরিকল্পিতভাবে রুদ্র সেনকে ধাওয়া দিয়ে পানিতে ফেলে হত্যা নিশ্চিত করে।
মামলার তদন্ত বর্তমানে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) পরিচালনা করছে। তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি পরিদর্শক মো. এমরান হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, এজাহারে যেসব নাম রয়েছে, তাদের অধিকাংশের সুনির্দিষ্ট ঠিকানা নেই। যাচাই-বাছাই করতে সময় লাগছে। আবার অনেকে দেশেই আছে, যাতে পালাতে না পারে— সে জন্য ইমিগ্রেশনে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এজাহারভুক্ত ৭৬ জনের মধ্যে ৫ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তবে এদের কেউ কেউ অন্য মামলায় গ্রেপ্তার ছিল, সেখান থেকে এ মামলায় দেখানো হয়েছে। ময়নাতদন্তের ভিসেরা রিপোর্টে পর্যাপ্ত মন্তব্য না থাকায় পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত তদন্ত শেষ করা যাচ্ছে না।
মামলার ধীরগতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে হাফিজুল বলেন, এ নিয়ে সিআইডি প্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তিনি বলেছেন, সিআইডিতে মামলা নাকি পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য উপাত্ত যাচাই করে প্রতিবেদন দেওয়া হয়। এটাই দেরির কারণ। অথচ মামলায় মাত্র ৫ জনকে গ্রেপ্তার দেখার কথা বললেও এটা ঠিক নয়। এদের অন্য মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আবার এই মামলায়ও গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তাহলে আসামি ধরা হলো কোথায়? মামলার আসামিরা কিন্তু সুনির্দিষ্ট ও চিহ্নিত। তাছাড়া ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনও প্রথমে উল্টাপাল্টা করেছে। এরপর পুনরায় ময়নাতদন্ত দেওয়ার কথা। এভাবে মামলার বিচার প্রক্রিয়া বিলম্ব করা হচ্ছে।
রুদ্র সেন হত্যার অন্যতম সাক্ষী ও শাবিপ্রবি শিক্ষার্থী আলী আব্বাস শাহিন বলেন, চব্বিশের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রুদ্র ছিলো অগ্রভাগে। সে আমাদের অনুপ্রেরণা। আমরা খুবই হতাশ যে এক বছর হয়ে যাওয়ার পরও রুদ্র সেনের হত্যাকারীদের বিচার হচ্ছে না। অন্তর্বর্তী সরকারকে বলছি, যাদের ত্যাগের মধ্য দিয়ে আপনারা এসেছেন, তাদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না। রুদ্র সেনসহ সকল শহীদদের হত্যার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। না হলে ছাত্র-জনতা আবারো রাজপথে নামতে প্রস্তুত।
প্রসঙ্গত, মামলাটি প্রথমে কোতোয়ালি মডেল থানায় তদন্তাধীন ছিল। পরে তা হস্তান্তর করা হয় সিআইডিতে। তবে তদন্ত এখনও শেষ হয়নি।
এনইউ/এমজে