সড়কে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন কারণে রাজধানীতে সবজির বাজার চড়া। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রাজধানীতে সবজি পরিবহনে সড়কে কয়েক দফা ব্যবসায়ীদের চাঁদা দিতে হয়।
এতে মাঠের কৃষক যেমন ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না, তেমনি ঠকছেন সাধারণ ভোক্তা।
বর্তমানে রাজধানীর খুচরা বাজারগুলোতে চড়া দামে সবজি বিক্রি হচ্ছে। দাম বাড়ার পেছনে ব্যবসায়ীরা টানা বৃষ্টি, পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি, পথে পথে চাঁদাবাজি ও উৎপাদন ঘাটতিসহ নানা কারণ দেখাচ্ছেন।
বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাজারে সবজির কোনো ঘাটতি নেই।
মূলত চাঁদাবাজি, কমিশন বাণিজ্য ও মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে সবজির দাম চড়া। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর এই চাঁদা তোলার ক্ষেত্র শুধু হাতবদল হয়েছে। পাইকারি আড়তে অবৈধ ‘কমিশন বাণিজ্য’ আগের মতোই পুরোদমে চলছে।
দেশে সবজির বড় উৎস বগুড়া, খুলনা, যশোর, পাবনা, রাজশাহী ও কুষ্টিয়া।
এসব এলাকার আড়ত থেকে সবজি নিয়ে পাইকারি ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন ঢাকায় আসেন। কৃষক সবজি বিক্রি করার পর ভোক্তার ব্যাগে ওঠার আগে ব্যাপারী, আড়তদার, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীসহ চার থেকে পাঁচ স্তরে মধ্যস্বত্বভোগীরা কয়েক দফা বাড়িয়ে দিচ্ছেন। এতে ভোক্তা বেশি দামে কিনলেও মাঠের কৃষক পাচ্ছেন সর্বশেষ দামের তিন-চার ভাগের এক ভাগ। মাঠে ঠকছেন কৃষক আর বাজারে ভোক্তা।
ভ্যালু চেইন ও বাজার পর্যায়ে সঠিক মনিটরিং না থাকা, ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা, পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি এবং উৎপাদন-সরবরাহে সমন্বয় না থাকায় বাজারে এমন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
একাধিক পাইকারি সবজি ব্যবসায়ীর ভাষ্য, এবার প্রচুর বৃষ্টি হওয়ায় সারা দেশে সবজির উৎপাদন কম। তাই কৃষকের কাছ থেকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। ঢাকায় নিয়ে যেতে কাঁচামাল পরিবহন খরচও বেশি পড়ছে। মহাসড়কের নির্দিষ্ট জায়গাগুলোতে পুলিশ থামালে বেশির ভাগ চালক কোনো কথা না বলে টাকা বের করে দেন। রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন সংগঠনের নামেও চাঁদা নেওয়া হয়। ঝামেলা এড়াতে চালকরা চাহিদামতো টাকা দিয়ে দেন। এই টাকা ভাড়া হিসেবে ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নিয়ে নেন চালকরা। এতে সব মিলিয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে প্রতি কেজি সবজিতে খরচ পড়ে যায় কেনা দামের প্রায় দ্বিগুণ। এরপর খুচরায় যেতে যেতে সবজির দাম আরো বেড়ে যায়।
এ ব্যাপারে বগুড়া ট্রাক লরি কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সরকার মুকুল বলেন, ‘৫ আগস্টের পর চাঁদাবাজি বেশ কিছুদিন বন্ধ ছিল। সম্প্রতি হঠাৎ করে হাইওয়ে পুলিশের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। সড়কে পণ্য পরিবহনকালে চাঁদা না দিলে তারা নানাভাবে হয়রানি করছে। ’
বগুড়া মোটর মালিক গ্রুপের সভাপতি অ্যাডভোকেট হামিদুল হক চৌধুরী হিরু বলেন, ‘সড়কে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু চাঁদাবাজি হলেও হাইওয়ে পুলিশের মতো নয়। সড়কে পণ্য বহনকালে তারা ব্যাপক চাঁদাবাজি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ’
গতকাল মহাস্থান হাটে উপস্থিত পণ্যবাহী সবজি ট্রাকের শ্রমিক রফিকুল ও কালামের ভাষ্য, মহাস্থান হাট থেকে সবজি নিয়ে ঢাকার কারওয়ান বাজার পর্যন্ত যেতে পাঁচ থেকে ছয় জায়গায় হাইওয়ে পুলিশসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পরিচয়ধারী লোকজন চাঁদা আদায় করছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কাভার্ড ভ্যান ট্রাক পণ্য পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মকবুল আহমেদ বলেন, ‘সরকার পরিবর্তনের পর পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি অনেকটাই কমে গিয়েছিল। আশা করেছিলাম, পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজিটা আর থাকবে না। কিন্তু সড়কে পুলিশসহ রাজনৈতিক দলের নেতাদের নামে ও নানা সংগঠনের নামে আবার চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন প্রবেশ পথে পণ্যবাহী ট্রাকে সবচেয়ে বেশি চাঁদাবাজি হচ্ছে। ’
গতকাল বৃহস্পতিবার বগুড়ার মহাস্থান হাটে কৃষক পর্যায়ে ও রাজধানীর খুচরা বাজারে সবজির দর বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বগুড়ার মহাস্থান হাটে কৃষকরা পাইকারিতে শীতের আগাম সবজি শিম বিক্রি করছেন মানভেদে ২৭ থেকে ৪০ টাকা কেজি, কিন্তু রাজধানীর মহাখালী কাঁচাবাজার, রামপুরা, বাড্ডা, জোয়ারসাহারাসহ বিভিন্ন খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ১৬০ থেকে ২২০ টাকা। অর্থাৎ রাজধানীর খুচরা বাজারে দাম চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি।
বগুড়ার কৃষকরা পাইকারিতে বেগুন বিক্রি করছেন প্রতি কেজি ২৭ থেকে ৪০ টাকা। খুলনার কৃষকরা বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়ার বাজারে ভালোমানের বেগুন বিক্রি করেন ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি। রাজধানীর খুচরা বাজারে সেই বেগুন মানভেদে ৮০ থেকে ১৪০ টাকা। কৃষক পর্যায়ে করলা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, রাজধানীর খুচরা বাজারে তা ৮০ থেকে ১০০ টাকা।
মহাস্থান হাটে কৃষকরা বরবটি ২৫ থেকে ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করলেও রাজধানীর খুচরায় তা ৯০ থেকে ১১০ টাকা। কৃষক পর্যায়ে পটোল প্রতি কেজি ২২ থেকে ২৫ টাকা, রাজধানীর খুচরা বাজারে এটি ৭০ থেকে ৮০ টাকা। কৃষকরা প্রতি কেজি ঝিঙা ২৭ থেকে ৩৩ টাকায় বিক্রি করছেন, রাজধানীর খুচরা বাজারে তা ৯০ থেকে ১০০ টাকা। কৃষক পর্যায়ে ঢেঁড়স ২০ থেকে ২৮ টাকা কেজি, রাজধানীর খুচরা বাজারে ৮০ থেকে ১০০ টাকা।
তিন গুণের বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে মিষ্টিকুমড়া। কৃষক পর্যায়ে প্রতিকেজি মিষ্টিকুমড়া ১৭ থেকে ২০ টাকা, রাজধানীর খুচরা বাজারে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। মহাস্থান হাটে প্রতি পিস লম্বা লাউ ১৫ থেকে ২৫ টাকা এবং খুলনার বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়ার বাজারে ১৭ থেকে ২৫ টাকা। সেই লম্বা লাউ রাজধানীর খুচরা বাজারে ৬০ থেকে ৮০ টাকা।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের খুচরা সবজি বিক্রেতা হুমায়ুন কবির বলেন, ‘সবজি নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণেই পাইকারির তুলনায় খুচরায় বেশি দামে বিক্রি করা হয়। পাইকারি পর্যায়ে অল্প সময়ের মধ্যে সব সবজি বিক্রি হয়ে যায়। কিন্তু খুচরায় প্রতিদিনের সবজি প্রতিদিন বিক্রি করা যায় না। এতে অনেক সবজি পচে যায়। এ কারণে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করতে হয়। ’
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য, যথাযথ তথ্যের অভাব, চাঁদাবাজি ও পণ্য পরিবহনে বাড়তি ব্যয় খুচরা বাজারে সবজির দাম বাড়ার ক্ষেত্রে বড় প্রভাব ফেলছে।
সম্প্রতি সবজির বাজার ব্যবস্থাপনায় সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের সুপারিশ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠায় বিটিটিসি। প্রতিবেদনে বলা হয়, সবজি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, যাত্রাবাড়ী, আমিনবাজার ও আব্দুল্লাহপুরসহ রাজধানীর প্রবেশপথে ‘আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী’ ও ‘বেসরকারি সংগঠনের’ নামে সবজির গাড়ি থেকে চাঁদা নেওয়া হয়। তবে কী পরিমাণ টাকা চাঁদা নেওয়া হয়, তা নির্দিষ্ট করে জানাননি তাঁরা।
বগুড়ার এক পাইকারি সবজি বিক্রেতার বরাত দিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, তাঁকে মহাস্থানগড় বাজার থেকে ঢাকার পাইকারি বাজারে যাওয়ার রাস্তায় অন্তত সাত জায়গায় চাঁদা দিতে হচ্ছে। যশোর ও মানিকগঞ্জের ব্যবসায়ীরাও একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ভলান্টারি কনজিউমারস ট্রেনিং অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস সোসাইটির (ভোক্তা) নির্বাহী পরিচালক মো. খলিলুর রহমান সজল বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ছাত্ররা যখন রাস্তাঘাটের দায়িত্বে ছিলেন, তখন চাঁদাবাজিটা কমে গিয়েছিল এবং এ ধরনের অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ ছিল। কিন্তু বর্তমানে এ বিষয়টি আরো অনেক বেড়ে গেছে। এতে পণ্য যখন মহানগরে আসে, তখন তা ভোক্তাদের ক্রয়সীমার বাইরে চলে যায়। ’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বাজার তদারকিতে সরকারের নজর কম। আগে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর যেভাবে বাজার তদারকি করত, এখন মনে হচ্ছে বাজারের মনিটরিংটা অনেকাংশে কমে গেছে। এতে পাইকারি ও খুচরা বাজারের দামের পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। মনিটরিং ছাড়া আপাতত বাজারকে ঠিক রাখা সম্ভব হবে না। ’
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বগুড়ার উপপরিচালক কৃষিবিদ সোহেল মো. শামসুদ্দিন ফিরোজ বলেন, ‘প্রান্তিক কৃষকরা প্রায় সব সময় বঞ্চিত হচ্ছেন। উৎপাদন ও পরামর্শ প্রদানের লক্ষ্যে কৃষি অধিদপ্তর যেমন ‘কৃষক গ্রুপ’ করেছে, তেমনি কৃষকদের ন্যায্যমূল্য পাইয়ে দিতে ‘কৃষি বিপণন’কে গ্রুপ করা প্রয়োজন। কৃষি বিপণনকে অনলাইন ও অফলাইন দুটিতেই শক্তিশালী করাসহ বাজার ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করতে হবে। ’
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন কালের কণ্ঠের নিজস্ব প্রতিবেদক, বগুড়ার টি এম মামুন ও নিজস্ব প্রতিবেদক, খুলনার এইচ এম আলাউদ্দিন]
আরবি