ঢাকা, রবিবার, ১৩ আশ্বিন ১৪৩২, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৫ রবিউস সানি ১৪৪৭

জাতীয়

জালের জঞ্জালে রুদ্ধ বিষখালীর গতিপথ

রফিকুল ইসলাম, পাথরঘাটা থেকে ফিরে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:৪৭, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২৫
জালের জঞ্জালে রুদ্ধ বিষখালীর গতিপথ

বরগুনার পাথরঘাটার গহরপুর গ্রামে বেড়িবাঁধের ঢালে ভাঙাচোরা ঘর। বাইরে পলিথিনের ছাউনি, পাশে মুরগির খাঁচায় গোঁজা ইলিশের জাল।

এই জাল দিয়ে একসময় বিষখালী নদীতে মাছ ধরতেন জেলে বারেক আকন। জালে মাছ ধরে চলত তাঁর ছয় সদস্যের সংসার। ৬০ বছর ছুঁই ছুঁই বারেক এখন আর নদীতে নামেন না।

বিষখালীর তীরে দাঁড়িয়ে বারেক বলেন, ‘মা জন্ম দিয়েছেন, কিন্তু পেট চালাত বিষখালী। এখন বয়স হয়েছে, কিন্তু নদীর বুকেও বার্ধক্য নেমেছে। কারণ জালের পর জাল ফেলে নদীর গতিপথ বন্ধ করে দিয়েছে। নদীর বুকজুড়ে এখন কেবল জাল আর জাল। শুকনা মৌসুমে নদী থমকে যায়, তখন স্রোত থাকে না, আর মাছেরও দেখা মেলে না। ’ বারেকের মতো তাঁর দুই ছেলেও ইলিশ ধরা ছেড়ে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।

বিষখালী নদীতে এখন খোঁটাজালের (স্থানীয়ভাবে পরিচিত খুঁটাজাল) বিস্তার। এই জালের জঞ্জাল ক্ষতি করছে সাধারণ জেলেদের জীবিকার, নদীর মাছের এবং সর্বতোভাবে নদীর।

এক যুগের বেশি সময় ধরে নদীর বুকজুড়ে বসানো হচ্ছে শত শত গাবগাছের খোঁটা। এসব খোঁটায় পাতা হচ্ছে বিশাল সব জাল। এতে সহজেই মা মাছ থেকে শুরু করে ছোট-বড় পোনা, বড় মাছ—সব আটকে যাচ্ছে এই জালে। ফলে নদীতে মাছের প্রজননব্যবস্থা ধ্বংস হচ্ছে। মাছ ধরা ব্যাহত হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ জেলেরা।

জেলেরা ছোট ছোট নৌকা নিয়ে নদীতে নামলেও জালে মিলছে না মাছ। খালি হাতে ঘরে ফিরতে হচ্ছে। স্থানীয় জেলে আব্দুস সামাদ বলেন, ‘আমাদের ছোট জাল ফেলে এখন আর কিছুই পাওয়া যায় না। খুঁটাজাল সব মাছ আটকে ফেলে। সংসার চালানো দায় হয়ে গেছে। ’

নদীজুড়ে জালের জঞ্জাল: বঙ্গোপসাগরের উৎসমুখ থেকে পাথরঘাটা পৌর এলাকার ভেতর পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার বিস্তৃত বিষখালীজুড়ে এখন অসংখ্য অবৈধ খোঁটাজাল। নদীর দুই পারের প্রভাবশালী অন্তত ২০০ ব্যক্তি এই বিষখালীর বিভিন্ন অংশের মালিকানা দাবি করেন। এসব অংশের দাবিদার ব্যক্তিরা বছরজুড়ে জাল পেতে নদীর স্বাভাবিক পানিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে নৌচলাচলের পথ বন্ধ করে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ স্থানীয় জেলেদের। তাঁরা বলছেন, এখন বিষখালী এক ‘জালের জঙ্গল’।

বিষখালীরই জেলে বারেক ফকিরের দুই ছেলে বেল্লাল ফকির ও বেলায়েত ফকির এখন নদীর ‘সীমানা নির্ধারক’। কার কোথায় জাল ফেলতে হবে, সেই নির্দেশ দেন তাঁরা। বেল্লাল বলেন, ‘প্রথমে নদীতে গাবগাছ পুঁততে হয়। এরপর রশি ও ভাসান বেঁধে দেওয়া হয় মার্কিং। দুটি মার্কিং বসাতে লাগে ১০ হাজার টাকা। কাজ শুরুর আগে অবশ্য দেখা হয়, মালিকানা কাগজপত্র আছে কি না। ’

কীভাবে এই সীমানা নির্ধারণ করা হয়, এমন প্রশ্নের সরাসরি জবাব মেলেনি। বেল্লাল এই প্রতিবেদককে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে বিষখালীর তীরে নিয়ে একটি শ্যালো মেশিন, একটি নৌকা, লম্বা পাইপ আর একটি মোটা লম্বা বাঁশ দেখালেন। এগুলো সীমানা নির্ধারণের উপকরণ।

সরেজমিনে গিয়ে হরিণঘাটা থেকে জিনতলা, বাদুড়তলা, টুলু পয়েন্ট, ছোনবুনিয়া—সবখানেই একই চিত্র দেখা যায়। খুঁটি পুঁতে, রশি টেনে, ফ্লোট ভাসিয়ে মাছ ধরার নির্দিষ্ট অঞ্চল ঠিক করে রেখেছেন স্থানীয় ‘মালিক’রা। বাড়ির পাশ দিয়ে নদী বয়ে গেছে—অনেকে সেই সূত্রে নদীতে ‘নিজের অংশ বিক্রি’ করেছেন।

যেভাবে নদী বিক্রি হয়: ২০১৪ সালের ২৭ ডিসেম্বরের একটি হলফনামা অনুযায়ী, পাথরঘাটার সরোয়ার সরদার এবং তাঁর ভাই ছগির সরদার নদীতে নিজেদের বলে দাবি করা অংশ বিক্রি করে দেন এক লাখ টাকায়। মাছ ধরার ‘সীমানা’ বদলের এই লেনদেন হলো পাথরঘাটা নোটারি অফিসে।

পাথরঘাটা জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতের আইনজীবী নুরুল ইসলাম ছিলেন নোটারি পাবলিক। তাঁর সহকর্মী আইনজীবী আবদুর রহমান জুয়েল ছিলেন সাক্ষী।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে নদীর সেই ‘অংশ’ আবার বিক্রি হয়েছে এক লাখ ৪০ হাজার টাকায়। ২০২০ সালে সেই অংশ থেকে কিছুটা আবার বিক্রি করা হয়। ক্রেতা-বিক্রেতা দুই পক্ষই বলছে, ‘নদী তো কারো নয়, আমরা শুধু মাছ ধরার জায়গাটা ঠিক করছি, যাতে কেউ কারো সীমানায় ঢুকে না পড়ে। ’

বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য সুভাষ চন্দ্র দাস বলেন, নদী ও খাল সরকারি সম্পত্তি। তাই এসব জলাশয়ে মাছ ধরার অধিকার সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। তিনি জানান, নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে নদী বা খালের জায়গা বিক্রি বা হস্তান্তর করার কোনো আইনগত ভিত্তি নেই।

পাথরঘাটা জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতের আইনজীবী নুরুল ইসলাম বলেন, নদীর জমি বিক্রি করা যায় না। কিন্তু বিষখালী নদীর তীরে রেকর্ডীয় জমির মুখে মাছ ধরার জায়গা নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে বণ্টন করা হচ্ছে। এতে একজনের নির্দিষ্ট জায়গায় অন্যজন প্রবেশ করতে পারছে না। পরবর্তী সময়ে একই প্রক্রিয়ায় মাছ ধরার জায়গা হস্তান্তরও করা হয়েছে।

নুরুল ইসলামের দাবি, এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ অবৈধ, এর কোনো আইনগত ভিত্তি নেই।

জালের ফাঁদে আটকে যায় মা ইলিশ: সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, হরিণঘাটা থেকে কাঁকচিড়া ফেরিঘাট পর্যন্ত নদীর বুকজুড়ে খোঁটাজাল। সাগর থেকে মা ইলিশ ডিম ছাড়ার জন্য নদীতে ঢুকতে চাইলে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এই জাল। ফলে ব্যাহত হচ্ছে প্রজনন।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও ইলিশ গবেষক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘খোঁটাজালের কারণে ইলিশের প্রজননে বড় ধরনের বাধা তৈরি হচ্ছে। এটি শুধু ইলিশ নয়, পরিবেশের জন্যও হুমকি। নিষিদ্ধ এই জাল অপসারণ করা জরুরি। ’

বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, পাথরঘাটায় নিবন্ধিত কাঠের নৌযানের মধ্যে আছে অন্তত ৫২০টি ট্রলার। কিন্তু বিষখালী জালের দখলে চলে যাওয়ায় ট্রলার চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।

প্রশাসনের অবস্থান: পাথরঘাটা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা হাসিবুল হক বলেন, ‘খোঁটাজাল ব্যবহার করে অন্তত ৩০০ জেলে অবৈধভাবে মাছ শিকার করছেন। এতে ইলিশের প্রজনন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ’

বরগুনার জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, ‘নদী জনগণের সম্পত্তি, কারো ব্যক্তিগত নয়। সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী সব নদীর অভিভাবক জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। খোঁটাজাল ইলিশের বংশনাশ ঘটাচ্ছে এবং ট্রলার চলাচলেও বাধা সৃষ্টি করছে। ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হবে। ’

বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মকসুমুল হাকিম চৌধুরী বলেন, ‘জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আমাদের কমিটি আছে। প্রতি মাসে তারা সভা করে রেজল্যুশন পাঠায়, আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। সম্প্রতি আমি দায়িত্ব নিয়েছি। বিষখালী নদীতে অবৈধ জালের বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে এ ধরনের কাজ চলমান থাকলে শুধু কমিশন নয়, জেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে মৎস্য বিভাগও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। ’

এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ