সরকারি ও বেসরকারি নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও সারা দেশে পথশিশুর সংখ্যা কমছে না। সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি পথশিশুদের মধ্যে মাদক গ্রহণের প্রবণতা বাড়ছে।
এই অবস্থায় শিশুদের সুরক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আজ ২৯ সেপ্টেম্বর শিশু অধিকার সপ্তাহ পালন শুরু হচ্ছে। প্রতিবছরের মতো এবারও শিশু অধিকার সপ্তাহ উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নানা কর্মসূচি পালিত হবে। এ ক্ষেত্রে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে পথশিশুরা।
তাদের বিষয়ে নানা সুপারিশ তুলে ধরা হবে। কিন্তু সেই সুপারিশ ও প্রস্তাব বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা নেই। ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে পথশিশুর সংখ্যা। রাজধানী ঢাকার প্রায় ১০ লাখ পথশিশুর জন্য মাত্র দুটি পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে।
একটি কমলাপুরে, আরেকটি কারওয়ান বাজারে। কেন্দ্র দুটিতে রয়েছে ১৫২ শিশুর থাকার ব্যবস্থা। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও ইউনিসেফ পরিচালিত ‘চাইল্ড সেনসিটিভ সোশ্যাল প্রোটেকশন ইন বাংলাদেশ, ফেইজ-২’ প্রকল্পের ২০২৪ সালের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৩৪ লাখের বেশি পথশিশু রয়েছে। অর্থনৈতিক চাপের কারণে এসব শিশুকে শ্রম দিতে বাধ্য করা হয়। তাদের শিক্ষার সুযোগ কমিয়ে দারিদ্র্যের চক্রে স্থায়ী করে রাখা হয়েছে।
মা-বাবার অবহেলা, দুর্ব্যবহার ও সামাজিক নিগ্রহসহ নানা বিরূপ পরিস্থিতির কারণে রাস্তায় বেরিয়ে আসতে হয়েছে তাদের। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) গবেষণায় বলা হয়, দেশে ৫৮ শতাংশ পথশিশু মাদকাসক্ত। ১৪ শতাংশ শিশু ১০ বছর বয়সের আগেই মাদক সেবন করে। তুলনামূলক সহজলভ্য ও সস্তা হওয়ায় পথশিশুদের মধ্যে ৩১.৭ শতাংশ গাঁজা সেবন করে। ড্যান্ডি মাদকে আসক্ত ১৫.২ শতাংশ শিশু। এ ছাড়া রাজধানীতেই ড্যান্ডিতে আসক্ত পথশিশুর সংখ্যা প্রায় ৭৫ হাজার।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রকাশিত ‘সার্ভে অন স্ট্রিট চিলড্রেন ২০২২’ প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের পথশিশুর ৪৮.৫ শতাংশ ঢাকা বিভাগে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ২২.৭ এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ১৮.৩ শতাংশের বসবাস। সবচেয়ে কম পথশিশু সিলেট বিভাগে, ৪ শতাংশ। পথশিশুর ৮২ শতাংশ ছেলে ও ১৮ শতাংশ মেয়ে। আর অর্ধেকের বেশি পথশিশুর বয়স ১০ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। প্রতি তিন পথশিশুর মধ্যে প্রায় একটি (৩৩ শতাংশের বেশি) জীবনের মৌলিক সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত। প্রায় অর্ধেক শিশু পাটের ব্যাগ, শক্ত কাগজ, প্লাস্টিকের টুকরা বা পাতলা কম্বল নিয়ে মাটিতে ঘুমায়।
বিবিএসের তথ্য বলছে, প্রতি ১০ পথশিশুর মধ্যে ৯টি বিভিন্ন কাজে যুক্ত। এর মধ্যে ভিক্ষুক ও ভিক্ষুকের সহায়তাকারী ১৮.৪ শতাংশ। ময়লা কুড়িয়ে (টোকাই) জীবন যাপন করছে ২০.৯ শতাংশ। তা ছাড়া যৌনকর্মী হিসেবে যুক্ত হচ্ছে মেয়ে পথশিশুরা। ঝাড়ু দেওয়া ও পরিচ্ছন্নতা কাজে যুক্ত ০.৫ শতাংশ পথশিশু। আর ঝুঁকিপূর্ণ পরিবহন খাত ও নির্মাণকাজে যুক্ত ১৬ শতাংশ পথশিশু। চায়ের দোকান, কারখানা ও ওয়ার্কশপে কাজ করে ১৪.৮ শতাংশ।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, ফুটপাতে, রেলস্টেশন, বাস কাউন্টার, টার্মিনাল, ফ্লাইওভার ও ফুট ওভারব্রিজের নিচে, এমনকি সড়ক বিভাজকের ওপর পথশিশুরা অবস্থান করে। কারওয়ান বাজার, কমলাপুর, পল্টন, বিমানবন্দর রেলস্টেশন, সদরঘাট এলাকায় এদের তৎপরতা বেশি। এদের অধিকাংশই মাদকাসক্ত। মাদকাসক্তের কারণে নানা অপরাধেও জড়াচ্ছে তারা। মাদক গ্রহণের পাশাপাশি বিক্রির সঙ্গে জড়িয়ে পড়া পথশিশুর সংখ্যা ৪৪ শতাংশ। ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে জড়িত ২১ শতাংশ পথশিশু। আবার এলাকাভিত্তিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে পথশিশুরা। ঢাকার বাইরেও ছোট-বড় শহরগুলোতে বিভিন্ন সড়কে পথশিশুদের স্বপ্ন-ভবিষ্যৎ এভাবেই গড়াগড়ি খাচ্ছে।
এ বিষয়ে স্ট্রিট চিলড্রেন অ্যাক্টিভিস্টস নেটওয়ার্কের (স্ক্যান) সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মুকুল কালের কণ্ঠকে বলেন, পথশিশুদের নিয়ে সরকারের উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। যেসব সংস্থা পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে, বাংলাদেশে তার সংখ্যাও অনেক কম। পথশিশুদের সমাজের মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে পুনর্বাসনের জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, সরকারি হিসাবে ৫৮ শতাংশ পথশিশু মাদকাসক্ত বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে তা ৭০ শতাংশের বেশি। মাদক গ্রহণের পাশাপাশি মাদক বিক্রিতেও তারা ব্যবহৃত হচ্ছে। আবার একটি বড় অংশ ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িত। ভিক্ষাবৃত্তি ও মাদকাসক্ত শিশুদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে হবে। এ জন্য ১০ বছরের নিচের পথশিশুদের বিদ্যালয়ে ফেরাতে হবে। ১০ বছরের বেশি বয়সীদের নন-ফরমাল এডুকেশন, প্রাথমিক শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষা দিতে হবে।
পথশিশুদের নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. লেনিন চৌধুরী। তিনি বলেন, শিশুরা যেন পথে না আসে সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। একইসঙ্গে পথে থাকা শিশুদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য প্রথমে পথশিশুদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে। সংখ্যা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি তাদের সুরক্ষায় সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সবাই মিলে তাদের পাশে দাঁড়ালে পথশিশুরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে।
তিনি আরো বলেন, পথশিশুদের পারিবারিক শৃঙ্খলা, শাসন ও আদর না থাকায় তারা মাদকে জড়িয়ে পড়ছে। মাদক সেবনের পাশাপাশি কন্যাশিশুরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। অনেক সময় তাদের পাচার করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি।
এএটি