বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভিশাপ শেখ হাসিনাকে স্বৈরাচারী দানবে পরিণত করেছে বলে মন্তব্য করেছেন করেছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার। স্বৈরাচার দানব ঠেকাতে সংসদীয় ব্যবস্থায় পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি।
বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আয়োজিত 'প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষ কি জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারবে?' শীর্ষক সিপিডি জাতীয় সংলাপে তিনি এ কথা বলেন।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, শেখ হাসিনা কিন্তু উর্দি পরে বা ট্যাংকে চড়ে ক্ষমতায় আসেননি। শেখ হাসিনা নির্বাচনের মাধ্যমে এসেছেন, যদিও নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু শেখ হাসিনা কীভাবে স্বৈরাচারে পরিণত হলেন, কীভাবে দানবে পরিণত হলেন? কারণ, এই স্বৈরাচারী ব্যবস্থাই তাকে দানবে পরিণত করেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভিশাপে যাতে দানব সৃষ্টি না হয়, দানব সৃষ্টি বন্ধ হয় তার জন্য উচ্চকক্ষ দরকার।
তিনি বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভিশাপের কারণে শেখ হাসিনা দানবে পরিণত হয়েছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভিশাপ আমরা দেখেছিলাম ২০০১ এবং ২০০৮ সালে। ২০০১ সালে বিএনপি ৪০ দশমিক ৯৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। আর আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৪০ দশমিক ১৩ শতাংশ ভোট। তখন বিএনপি ১৯৩টি আসন পায়, আওয়ামী লীগ পায় ৬২টি আসন। সংখ্যাগরিষ্ঠতার এই অভিশাপের জন্য ওনাদের দল (বিএনপি) অনেক কিছু করেছে। যার ফলশ্রুতিতে আমাদের এক/এগারো দেখতে হয়েছে।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ২০০৮ সালে আমরা আবার সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভিশাপ দেখেছি। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছিল ৪৮ শতাংশ, বিএনপি পেয়েছিল ৩২ শতাংশ ভোট। আওয়ামী লীগ আসন পেয়েছে ২৩০ এবং বিএনপি আসন পায় মাত্র ৩০টি। এ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভিশাপ শেখ হাসিনাকে দানবে পরিণত করেছি। পিআর পদ্ধতি হলে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ পেতো ১৪৪ আসন এবং বিএনপি পেতো ৯৯ আসন। ফলে সংবিধান সংশোধন করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে হতো।
তিনি বলেন, শেখ হাসিনা দানবে পরিণত হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ পঞ্চদশ সংশোধনী, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল। পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ থাকলে শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা প্রায় অসম্ভব ছিল।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্য হলো এই স্বৈরাচারী ব্যবস্থা বা দানবীয় ব্যবস্থার অবসান ঘটানো। অবসান না ঘটালেও কিছু চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স করা, ক্ষমতার ভারসাম্য করা। আমেরিকার সংবিধানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এ ক্ষমতার ভারসাম্য। সেটার মাধ্যমে দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করতে পারি এবং দানব সৃষ্টি হওয়া বন্ধ করতে পারি।
তিনি বলেন, এই যে দানবে যাতে পরিণত না হন, তার প্রতিষেধক হিসেবে বা এটি ঠেকানোর জন্য উচ্চকক্ষ প্রয়োজন। উচ্চকক্ষের মাধ্যমে চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স সৃষ্টি হতে পারে। যে কোনো আইন পাস হলে তা উচ্চকক্ষে যাবে এবং এ নিয়ে উচ্চকক্ষের একটি বক্তব্য থাকবে, যার ফলে আমাদের দেশে অনেকগুলো নিবর্তনমূলক আইন হয়তো আরও মডারেটেড হতো। অনেক সময় নিম্নকক্ষে আবেগ এবং প্রতিহিংসাপরায়ণতার কারণে আইন প্রণীত হয়। কিন্তু উচ্চকক্ষে গেলে তা মডারেটেড হতে পারে এবং উচ্চকক্ষ এটাকে ঠেকাতে পারে। নিম্নকক্ষের কাছে মূল ক্ষমতা আইন প্রণয়নে রয়েছে এবং উচ্চকক্ষের কোনো ক্ষমতা নেই আইন প্রণয়ন ও আইন প্রস্তাব করার।
তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় কথা হলো শেখ হাসিনা দানবে পরিণত হয়েছেন, পঞ্চদশ সংশোধনী এবং এর মাধ্যমে তিনি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করেছেন। যে সরকার যখন ক্ষমতায় থাকবে, সেই সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে এবং তার পরিণতি কী হয়েছে, সেটা আমরা দেখেছি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পর সবগুলো নির্বাচনই জালিয়াতি নির্বাচন হয়েছে, না হয় একতরফা বা বিতর্কিত নির্বাচন হয়েছে। উচ্চকক্ষ যদি থাকত, তাহলে শেখ হাসিনার পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা প্রায় অসম্ভব হতো। যদিও নির্ভবর করে উচ্চকক্ষ কীভাবে গঠিত হয় তার ওপর নির্ভর করে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক রওনক জাহানের সভাপতিত্বে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাংলাদেশের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠানে ইইউ রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার, বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় সদস্যসচিব আখতার হোসেন ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বক্তব্য রাখেন।
এমইউএম/এসসি