ঢাকা: এমনিতেই লোকসানের ভারে নুয়ে পড়ছে রেলওয়ে। আয় নেই, খরচের খতিয়ান শুধু বাড়ছেই! পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভর্তুকিও।
এখন রেলের জন্য বোঝা হয়ে পড়েছে এ ট্রেন।
ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট- ডিইএমইউ (ডেমু) ট্রেন নিয়ে এখন চরম বিপাকে রেল কর্তৃপক্ষ। যাত্রীদের সুবিধার জন্য এ কমিউটার ট্রেন নামানো হলেও এখন তা বিরক্তির কারণ হয়ে দাড়িয়েছে।
বেশি যাত্রীর ভারও বহন করতে পারে না ট্রেনটি। যারা এ ট্রেনে চলাচল করছেন তাদের অনেকেই পর্যাপ্ত বাতাসের অভাব ও গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। গরমের কারণে জানালা খুলে রাখলেও নিস্তার নেই! বৃষ্টি হলেই যাত্রীরা ভিজে একাকার। ইলেকট্রিক এ ট্রেনে যাত্রীরা এখন না পারছেন জানালা বন্ধ রাখতে, না পারছেন খোলা রাখতে! ভেতরে নেই টয়লেটও!
ট্রেনের এ বেগতিক অবস্থা দেখে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের ক্ষুব্ধ যাত্রীরা ভাংচুরও চালিয়েছেন ডেমুর ওপর। ফলে রেল কর্তৃপক্ষ এ ট্রেন উদ্বোধনের পরই বন্ধ করে দেয়।
গত ২৪ এপ্রিল কমলাপুর রেলস্টেশনে বেশ জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডেমু ট্রেন উদ্বোধন করলেও পরদিনই যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এটি বন্ধ হয়ে যায়।
ওয়ার্কশপ থেকে আনার পর আগের সময়সূচি অনুযায়ী দু’দিন পর ডেমু ট্রেন চালু হলেও পর্যাপ্ত বাতাসের অভাব ও গরমে যাত্রীরা অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর ভাংচুরের ঘটনাও ঘটে।
অধিক যাত্রী পরিবহন করলেই ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। তাই সেবা সচল রাখতে যাত্রী কম থাকার সময়কে বেছে নিতে হয়েছে। গত ৩০ এপ্রিল থেকে তাই এ ট্রেন চলছে আগের সময়সূচি পাল্টে অফপিক ও সুপার অফপিক আওয়ারে।
রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, চীন থেকে আনা দুই সেট (প্রতি সেটে তিন ইউনিট) কমিউটার ট্রেন এখন দিনে তিনবার ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচল করছে। সকাল ৫টা ৪০ মিনিট ও রাত ১০টায় ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া এ ট্রেনে যাত্রী উঠছেন ১০০-১৫০ জন। আর বেলা ১টা ৪০ মিনিটের ট্রিপে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে সর্বোচ্চ ৩০০ জন। অথচ এর যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ৬০০ জন। চলাচলের সময়সূচি হিসেবে অফপিক ও সুপার অফপিককে বেছে নেওয়ায় যাত্রী কমে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেললাইনেরও খুবই নাজুক অবস্থা। এ ট্রেনে যাতায়াত করা যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যে দ্রুতগতিতে এ ট্রেন চলে সে গতিতে চলার জন্য এ রেললাইন নিরাপদ নয়।
রেলওয়ে সূত্রেও জানা গেছে, এ রুটে অতি পুরোনো স্লিপার, পর্যাপ্ত পাথর না থাকা ও নাট-বল্টু ঠিক আছে কিনা তা নিয়মিত তদারকি না থাকায় দ্রুতগামী ডেমু ট্রেন চলাচলের উপযোগী নয়।
যাত্রীরা জানিয়েছেন, এ ট্রেনের সমস্যার অন্ত নেই। তারা জানান, পুরোনো ট্রেনগুলোর ৭টি বগিতে প্রতি ট্রিপে যেখানে গড়ে ১ হাজার ৫শ’ যাত্রী চড়তে পারেন, সেখানে কমিউটার ট্রেনে মাত্র ৫শ’র মতো যাত্রী যাতায়াত করতে পারেন। এছাড়া নিচু প্লাটফরম থেকে কমিউটার ট্রেনের উঁচু কম্পার্টমেন্টে উঠতে গিয়েও দুর্ঘটনার আশঙ্কা করেছেন অনেকেই। ট্রেনে ওঠার সিঁড়িগুলোও (পাদানি) ভেতরের দিকে ঢুকানো, হাতলগুলোরও একই অবস্থা। হাইড্রলিক দরজাগুলো বন্ধ ও খুলতে গেলেও যে কোনো মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে দুর্ঘটনা। পুরোনো ট্রেনগুলো মজবুত ও জানালাগুলো সম্পূর্ণ খোলা গেলেও এ ট্রেনের জানালাগুলো অর্ধেক খোলা যায়। ফলে পর্যাপ্ত বাতাস আসে না।
জানা গেছে, রেলওয়ের অপারেশন বিভাগের আপত্তি সত্ত্বেও ৬৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা হয় নিম্নমানের ডেমু ট্রেন। এ প্রকল্পে যে অর্থ ব্যয় হয়েছে, তাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে নতুন ১০-১২টি ট্রেন চালু করা যেত।
বাংলাদেশ রেলওয়ের ডেমু পরিচালনায় গঠিত কমিটির আহ্বায়ক পার্থ সরকার বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘ডেমু সার্ভিস উন্নত বিশ্বে স্বল্প দূরত্বের যাত্রায় কার্যকর হলেও বাংলাদেশে প্রথম হওয়ায় প্রথম দিকে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। যেসব সমস্যা রয়েছে তা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। ’’
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে আরও দুই সেট, ঢাকা-জয়দেবপুর রুটে দুই সেট ও চট্টগ্রামের সার্কুলার রুটে দুই সেট ডেমু ট্রেন চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রেলওয়ে। কিন্তু ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে প্রথম দুই সেটের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে এখনও তা কার্যকর করা হয়নি। ফলে পরীক্ষামূলক পরিচালনা শেষে ট্রেনগুলো বসিয়ে রাখা হয়েছে। দেশে আসার পর বাকি ১২ সেট ট্রেন পর্যায়ক্রমে আরও ছয়টি রুটে চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু এ ট্রেনের বিভিন্ন অসুবিধার কারণে তা নিয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে রেলওয়ে।
সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরত্বেই যাত্রীরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
সেখানে ৪৫-৫০ কিলোমিটার দূরত্বের রুটে চলাচল অবস্থা কি হবে? সে কারণে ট্রেন নামানোর সাহস পাচ্ছে না রেলওয়ে।
রেলওয়ে সূত্র আরও জানায়, চীন থেকে ২০ সেট ডেমু ট্রেন কেনায় সরকারের ব্যয় হচ্ছে ৬৬২ কোটি টাকা। অথচ এ অর্থে ১০টি ইঞ্জিন ও ১২০টি কোচ কেনা সম্ভব, যাতে নতুন ১০টি ট্রেন পরিচালনা করা যায়। এছাড়া ডেমু ট্রেনের ইঞ্জিন ও বগি সাধারণ ট্রেনের তুলনায় অনেক হালকা ও কম টেকসই। ট্রেনগুলোয় টয়লেটের ব্যবস্থা না থাকায় দূরপথে ভ্রমণ করতে গিয়েও যাত্রীরা সমস্যায় পড়বেন।
রেলের অপারেশন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, রেলওয়ের ক্ষতির কথা বিবেচনা করে আগেই এ ট্রেন কেনার বিপক্ষে মতামত দিয়েছিল অপারেশন বিভাগ।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো: আবু তাহের বাংলানিউজকে বলেন, “উন্নত বিশ্বে এ ট্রেন ভালো সেবা দিচ্ছে। রেলকে আধুনিকায়নের অংশ হিসাবে যাত্রীদের সুবিধার জন্য এ ট্রেন চালু করা হয়েছে। এখন সাময়িক যেসব অসুবিধার কথা আসছে তার অনেকটাই নিরসন হয়েছে এবং হচ্ছে। ’’
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, কমিউটার সার্ভিসের জন্য ১০টি রুট নির্ধারণ করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। পূর্বাঞ্চলের সাতটি ও পশ্চিমাঞ্চলের তিনটি রুটে চলবে এসব কমিউটার ট্রেন।
কমিউটার সার্ভিসের জন্য নির্ধারিত পূর্বাঞ্চলে রুটগুলো হলো— ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা (৪ সেট), ঢাকা-ভৈরব-ঢাকা (২ সেট), ঢাকা-জয়দেবপুর-ঢাকা (২ সেট), চট্টগ্রাম-দোহাজারী-চট্টগ্রাম (২ সেট), চট্টগ্রাম-লাকসাম-চট্টগ্রাম (২ সেট), লাকসাম-নোয়াখালী-লাকসাম (১ সেট) ও লাকসাম-চাঁদপুর-লাকসাম (১ সেট)। এ ছাড়া পশ্চিমাঞ্চলের লালমনিরহাট-বুড়িমারী-লালমনিরহাট (২ সেট), লালমনিরহাট-দিনাজপুর-লালমনিরহাট (২ সেট) ও লালমনিরহাট-বগুড়া-লালমনিরহাট (২ সেট) রুটেও এ ট্রেন চালানো হবে।
জানা গেছে, যাত্রীসেবার মানোন্নয়ন ও যানজট নিরসনে চীনের তাংসাং রেলওয়ে ভেহিকেল কোম্পানি লিমিটেড থেকে ২০ সেট ডেমু ট্রেন কিনতে ২০১১ সালের ৪ আগস্ট চুক্তি করে রেলওয়ে। এ প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৬৬২ কোটি টাকা। বর্তমানে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে এ ট্রেন চলাচল করছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩২১ ঘণ্টা, মে ১৮, ২০১৩
এডিএ/ সম্পাদনা: অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর- [email protected]; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর