নরসিংদী: নরসিংদী সদর রেল স্টেশনে বুধবার বিকেলে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে কমপক্ষে ১২ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছেন। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
পৌনে পাঁচটার দিকে চট্টগ্রাম থেকে আসা চট্টলা এক্সপ্রেস এবং বিপরীত দিক থেকে আসা মহানগর গোধুলী ট্রেনের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে চট্টলা ট্রেনটি মহানগর ট্রেনের উপর উঠে যায়।
ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ও পুলিশ সদস্যরা প্রথমে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেন। পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেন সেনাবাহিনী, আনসার, ভিডিপি ও পুলিশের ৪০০ থেকে ৫০০ সদস্য। উদ্ধার তৎপরতা এখনো চলছে।
ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের পরিচালক মেজর মতিন জানিয়েছেন, খুবই সতর্কতার সঙ্গে উদ্ধার কাজ চলছে। ঢাকা সদর দপ্তর, টঙ্গী ও নরসিংদীর দমকল সদস্যরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। উদ্ধারকাজ কখন শেষ হবে তা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না।
রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নরসিংদীর ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রাণহানিতে গভীর দুঃখ ও শোক প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী দুর্ঘটনায় আহতদের অবিলম্বে সুচিকিৎসা নিশ্চিত ও উদ্ধারকাজে অংশ নিতে সেনাবাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপকে নির্দেশ দিয়েছেন। শোক প্রকাশ করেছেন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াও।
এ ব্যাপারে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বাংলানিউজের কাছে আসা তথ্য অনুযায়ী, ঘটনাস্থলে ৮ জন, ঢাকায় পঙ্গু হাসপাতালে ১ জন ও নরসিংদির হাসপাতালে ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে এদের পরিচয় জানা যায়নি। নিহতদের মধ্যে একজন ট্রেনচালক রয়েছেন।
ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দীন আহমদ রাজু উদ্ধারকাজ তদারকি করেন। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে যোগাযোগমন্ত্রীও সেখানে যান।
রাত ৯টায় ভৈরব থেকে উদ্ধারকারী ট্রেন নরসিংদীর ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কাজ শুরু করে।
নরসিংদী পুলিশের ডিআইও গোলাম সারোয়ার বাংলানিউজকে ১০ জনের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করে বলেন, ‘এ পর্যন্ত ১০টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে হতাহতদের নরসিংদী জেনারেল হাসপাতাল ও ১০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। ’
এর আগে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে নরসিংদী পুলিশ সুপার ড. আক্কাস উদ্দিন ভূঁইয়া বাংলানিউজকে জানান, ওই সময় পর্যন্ত চারটি লাশ উদ্ধার করে নরসিংদী হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়েছে। এছাড়া ট্রেনের মধ্যে আরও তিনটি লাশ দেখা যাচ্ছে। তবে এখনও সেই লাশ উদ্ধার যায়নি।
ভুল সিগন্যালই মৃত্যুর কারণ!
স্টেশনের অদূরে বটতলা এলাকার বাসিন্দা বাবুল মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, ‘ভুল সিগন্যালের কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখী মহানগর গোধুলী ট্রেনটি ছিলো লোকাল লাইনের আর চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা অভিমুখী চট্টলা এক্সপ্রেসটি ছিল ডাইরেক্ট লাইনের। কিন্তু ভুল সিগন্যালের কারণে চট্টলা এক্সপ্রেস ট্রেনটি চলে আসে লোকাল লাইনে। এ অবস্থায় নরসিংদী স্টেশনের বটতলা বাজারের কাছে বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটে ট্রেন দুটির মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। ’
বাবুল মিয়ার দাবি দুর্ঘটনার সময় স্টেশনে কোনো লাইনম্যান ছিল না।
এদিকে, রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঘটনাস্থল থেকে বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট মো: জসীম উদ্দীন ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের পরিচালক মেজর মতিনের উদ্ধৃতি দিয়ে জানান, ট্রেনের এ দুর্ঘটনা ছিল কতটা ভয়াবহ তা চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না। শুধু ট্রেনের ভেতর থেকেই ৮জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া ৮-১০জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গুরুতর আহত অবস্থায় পাঠানো হয়েছে। মেইল ট্রেন চট্টলারই ক্ষতি হয়েছে বেশি। নিহতদের বেশিরভাগই এ ট্রেনের যাত্রী।
দুর্ঘটনায় মহানগর গোধূলীর চালক মোহাম্মদ জহুরুল হকও (৬৫) মারা গেছেন বলে জানান তিনি।
এছাড়া ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে আহত আরো ১০ জনকে ভর্তি করার পর রাত সাড়ে ১০টার দিকে শফিউল আলম নামে রেলওয়ের এক নিরাপত্তাকর্মী মারা যান বলে আমাদের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট আজিজুল হাকিম জানান। ।
এর আগে আজিজুল হাকিম জানান, রাত ১০টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেডিকেলে ট্রেনের ৩ চালক, ১ নিরাপত্তাকর্মী, ২ জন টেকনিশিয়ান ও ২ জন যাত্রীকে ভর্তি করা হয়েছে বলে জানান।
এছাড়া নরসিংদী সদর হাসপাতাল থেকে আমাদের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট তুহিন শুভ্র অধিকারী জানান, ওই হাসপাতালে ৯জন চিকিৎসাধীন রয়েছে। যাদের বেশিরভাগই শিশু।
তদন্ত কমিটি গঠন
নরসিংদীতে সংঘটিত মর্মান্তিক ট্রেন দুর্ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশ রেলওয়ে ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী ইউসুফ আলী মৃধার নেতৃত্বে ৪ সদস্যের কমিটিকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট, চিফ সিগনাল অ্যান্ড টেলিকম ইঞ্জিনিয়ার এবং চিফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার।
এছাড়া এ দুর্ঘটনা তদন্তে বিভাগীয় পর্যায়ে ৪ সদস্যের আরো একটি তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। বিভাগীয় ট্রাফিক অফিসার মো. নাজমুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত কমিটিকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। এ কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- ডিভিশনাল মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, ডিভিশনাল সিগনাল অ্যান্ড টেলিকম ইঞ্জিনিয়ার এবং ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার। দু’টি কমিটি এরইমধ্যে কাজ শুরু করেছে।
শোক প্রকাশ অব্যাহত
রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নরসিংদীতে মর্মান্তিক ট্রেন র্দুটনায় নিহতদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি শোক ও আহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী ঘটনার পরপরই উদ্ধার কাজে অংশ নেওয়ার জন্য সামরিক-বেসামরিক কর্তৃপকে নির্দেশ দেন। আহতদের যথাযথ চিকিৎসা প্রদানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপকে তড়িৎ ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দেন তিনি।
শোক প্রকাশ করেছেন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও।
এছাড়া সংসদের স্পিকার অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ, ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর মকবুল আহমদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন শোক প্রকাশ করেছেন।
৫ ঘণ্টা পর ট্রেন চলাচল শুরু
ওদিকে, রাত সাড়ে ৯টায় স্টেশন মাস্টার মরণ চন্দ্র দাস বাংলানিউজকে জানান, দুর্ঘটনার কারণে ৪টি ট্রেন বন্ধ ছিল। রাত সাড়ে ৯টায় নরসিংদী থেকে সুবর্ণ এক্সপ্রেস চট্রগ্রামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।
ট্রেন দুর্ঘটনায় আহত ৮ জন ঢামেকে, ৯ জন পঙ্গুতে, চিকিৎসার সব ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ
নরসিংদীর ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত আট জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) ও ৯ জনকে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
তারা হলেন- চট্টলা এক্সপ্রেসের চালক রফিক উদ্দিন, সহকারী চালক মাইনুদ্দিন, মহানগর গোধূলীর সহকারী চালক আরিফুর রহমান, রেলওয়ের নিরাপত্তাকর্মী জসিম উদ্দিন, ট্রেনের যাত্রী মাহবুব আলম, হুমায়ুন কবির ও আবু তাহের সুলতান।
এদের মধ্যে রফিক উদ্দিন, মাইনুদ্দিন ও জসিম উদ্দিনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে চিকিৎসকরা জানান।
ঢামেকে ভর্তি করা রোগীদের প্রত্যেকেই মাথা, বুক, চোখ ও পায়ে আঘাতপ্রাপ্ত। চট্টলা এক্সপ্রেস ট্রেনের চালক রফিক উদ্দিনের মাথায় ২৫টিরও বেশি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার পর থেকে আহতদের ঢামেকে আনা শুরু হয়।
আহতদের দেখতে হাসপাতালে আসেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আফম রুহুল হক, প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য, পরিবার ও সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা প্রফেসর ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. ক্যাপ্টেন (অব.) মুজিবুর রহমান ফকির, ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শহিদুল হক মল্লিক।
হাসপাতালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজে আহতদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন এবং কর্তব্যরত চিকিৎসকদের প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দেন।
পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা পুরোপুরি প্রস্তুত। এখানে সব ধরনের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যতক্ষণ প্রয়োজন হবে ততক্ষণ চিকিৎসক, সেবিকাসহ হাসপাতালের সব কর্মী আহতদের সেবায় নিয়োজিত থাকবে। চিকিৎসার জন্য রোগীদের কোনও ধরনের খরচের প্রয়োজন হবে না। ’
প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য, পরিবার ও সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা প্রফেসর ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বলেন, ‘চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। এখানে সবাই আন্তরিকভাবে কাজ করছেন। আহত কোনও ব্যক্তির আর্থিক কোনও সমস্যা থাকলে আমরা তাকে সহায়তা দেবো। ’
হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসায় প্রায় ৬০ জন চিকিৎসক নিয়োজিত রয়েছেন বলে তিনি জানান।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যেকোনও ধরনের সহযোগিতার জন্য তিনটি মোবাইল নম্বর সংবাদমাধ্যমে মাধ্যমে প্রকাশের ব্যবস্থা করেছেন। এসব নম্বরে যোগাযোগ করলে আহতরা প্রয়োজনীয় সেবা পাবেন। মোবাইল নম্বরগুলো হলো: ০১৭১২-৫৯৮৪০৭, ০১৭১৮-১৩৭৪২২, ০১৭১১-৬২২১৩৩।
এদিকে পঙ্গু হাসপাতালে গুরুতর অবস্থায় ভর্তি হওয়া ১০ জনের মধ্যে ১ জন মারা যান। তিনি হচ্ছেন রেলওয়ে নিরাপত্তা কর্মী শফিউল আলম(৫৫)।
এ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বাকি ৯ জন হলেনÑ জয়নাল আবেদীন (৩২), রাশেদুল মিন্টু (৩৫), নাজমুল হক (২২), শরীফ (২২), জামাল (৫০), মোস্তফা (৫০), জাকারিয়া (৫৫), শাফায়েতুল্লা শুভ (১৭), গোধূলীর চালক জিকে ঘোষ (৫০)।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮, ২০১০