ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তালিকা

রোহিঙ্গা মদদদাতাদের শীর্ষে এমপি বদী

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৫৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৮, ২০১৪
রোহিঙ্গা মদদদাতাদের শীর্ষে এমপি বদী

ঢাকা: সরকার দলীয় এমপি আবদুর রহমান বদীকে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় যুক্ত হতে সহায়তাকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে সরকার। খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়েছে নির্বাচন কমিশনে।

এমপি বদী ছাড়াও দুই জেলার বেশ কয়েকজন উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তালিকায় রয়েছেন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাও। এছাড়াও বিভিন্ন স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ স্কুল ও মাদ্রাসা শিক্ষকের নাম এই তালিকায় স্থান পেয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পরিচালক মোহাম্মদ মোখলেসুর রহমান সরকারের স্বাক্ষরিত চিঠিটি নির্বাচন কমিশনে পৌঁছানোর পর এ বিষয়ে ব্যবস্থাগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে কমিশন।

চিঠিতে কক্সবাজার ও বান্দরবানের মোট ৫১ জনকে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করায় সহায়তাকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে কক্সবাজারের ৪৬ জনের তালিকার শীর্ষে রয়েছে খোদ সরকারি দলের এমপি আবদুর রহমান বদীর নাম। বান্দরবানে অভিযুক্ত পাঁচ জনের মধ্যে সদর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মাইনুল হকের নাম রয়েছে।

এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে পাওয়া চিঠি আমলে নিয়ে সোমবার রোহিঙ্গা অন্তর্ভূক্তিকরণে সহায়তাকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও নির্বাচন কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।  

কমিশনের জ্যেষ্ঠ সহকারি সচিব মাহফুজা আক্তার স্বাক্ষরিত নির্দেশনায় পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের পর ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক, জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও সকল উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে এই নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে।

ভোটার তালিকা থেকে রোহিঙ্গাদের নাম কেটে দেওয়া, জাতীয় পরিচয়পত্র বাতিল করা, অশনাক্ত রোহিঙ্গাদের শনাক্ত করার নির্দেশনার পাশাপাশি ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভূক্ত করতে সহায়তাকারী স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ চিহ্নিত সকলের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে এই চিঠিতে।

একইসঙ্গে জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে বিশেষ কমিটি গঠন করে ব্যাপক অনুসন্ধানের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নিয়মিতভাবে চিহ্নিতকরণ ও বাদ দেওয়ার কাজ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
 
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চিঠিতে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে, রোহিঙ্গারা শুধু তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না, তারা দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত হয়ে দেশবিরোধী নানা কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।

কক্সবাজারে অভিযুক্তদের তালিকায় এমপি বদি ছাড়াও রয়েছে টেকনাফের উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমেদ, ভাইস চেয়ারম্যান রফিক উল্লাহ, কক্সবাজার সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জামায়াত নেতা জিএম রহিমুল্লাহর নাম। এছাড়া বাকি ৪২ জনের মধ্যে ছয় জন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, অন্তত দুই ডজন ইউপি সদস্য, ছয় জন পৌর মেয়র বা কাউন্সিলর রয়েছেন। বাকিকের মধ্যে রয়েছেন ইন্সুরেন্স কর্মকর্তা, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, যুবদল নেতা ও চিহ্নিত দালাল।

বান্দরবানের অভিযুক্ত পাঁচ জনের মধ্যে নির্বাচন কর্মকর্তা ছাড়া বাকি চারজনই স্কুল শিক্ষক যারা তথ্য সংগ্রহকারী হিসেবেও ‍কাজ করেছেন।
 
যেভাবে ভোটার হচ্ছে রোহিঙ্গারা:
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, রোহিঙ্গারা অবৈধভাবে বাংলাদেশের সীমান্তে ঢুকে সমুদ্রসৈকত সংলগ্ন বস্তিসহ আশপাশের আত্মীয় স্বজনের বাড়ি বা বিভিন্ন ভাড়া বাসায় অবস্থান নেয়। এভাবে মাস বা বছর পার করে রোহিঙ্গারা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় জায়গা কিংবা বনভূমি দখল করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। অনেকে অর্থের বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যের বা চেয়ারম্যানের মাধ্যমে নাগরিকত্বের সনদ বা জন্মসনদও সংগ্রহ করে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়।
 
অনেক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ এদেশে বিয়ে করে শ্বশুরের পরিচয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে নাগরিকত্ব সনদ বা জন্মসনদ নিয়ে ভোটার হচ্ছে।
 
কেউ অর্থের বিনিময়ে স্থানীয় পরিবারগুলোকে পিতা-মাতা বা আত্মীয় বানিয়ে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করেও ভোটার হয়।
 
রোহিঙ্গারা কক্সবাজারসহ কয়েকটি পার্বত্য জেলায় প্রথমে একটি ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে ভোটার হয়। পরে অন্য জায়গায় গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।
 
রোহিঙ্গাদের অপতৎপরতাঃ
প্রধানমন্ত্রীর দফতরের পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, কক্সবাজার জেলায় ৩৮৯ জন ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। এছাড়াও বান্দরবান জেলায় আরো ৪৯ জন রোহিঙ্গা ভোটার তালিকায় যুক্ত হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।

এরা এদেশে আশ্রয় নিয়ে বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত হওয়াসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী এবং সীমান্ত অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যাচ্ছে বলে গোয়েন্দারা প্রমাণ পেয়েছেন। আবার মানব পাচার, অস্ত্র চোরাচালানসহ ইয়াবার মতো মাদকদ্রব্যের ব্যবসার সাথেও জড়িত হয়ে পড়েছে এই রোহিঙ্গারা।
 
অনেক রোহিঙ্গা তাদের সন্তানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির মাধ্যমে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ পেয়ে যাচ্ছে। পরে জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় সরকারি কিছু অসাধু কর্মকর্তার মাধ্যমে পরিচয়পত্র নিয়ে পাসপোর্টও সংগ্রহ করছে তারা। এরাই বিদেশে পাড়ি দিয়ে বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করছে।
 
বর্তমানে দেশে প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের তথ্য রয়েছে বলে, নির্বাচন কমিশন সূত্র জানিয়েছে।
 
সম্প্রতি শেষ হওয়া ভোটার তালিকার সর্বশেষ হলানাগাদের সময় বিশেষ কমিটি গঠন করেও  কমিশন অনেকটা অসহায় হয়ে পড়ে। এর আগে ২০০৮ সালের ভোটার তালিকা শুরু করার সময় রোহিঙ্গা সন্দেহে প্রায় ৫০ হাজার আবেদনপত্র বাতিল করে কমিশন। এরপর ২০১০ সালের হালনাগাদের সময় ১৭ হাজার আবেদনপত্র বাতিল করে। আগামী জানুয়ারিতে চলতি ভোটার তালিকা হালনাগাদ করে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে।

এ বিষয়ে বাংলানিউজের কথা হয় নির্বাচন কমিশনার শাহ নেওয়াজের সঙ্গে। তিনি বলেন, খসড়া তালিকা প্রকাশের পর কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে এবারও রোহিঙ্গাদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে।

প্রধানমন্ত্রীর দফতরের পত্রের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার শাহ নেওয়াজ বাংলানিউজকে বলেন, ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গাদের অবৈধ অন্তর্ভূক্তি ঠেকানোর বিষয়ে চিঠি পেয়েছি। সে মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
 
নির্বাচন কমিশনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, সংসদ সদস্যও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নিতে স্পিকার ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হলে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যেত।
 
বাংলাদেশ সময়: ০২৫৬ ঘণ্টা, ০৮ ডিসেম্বর, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।