ঢাকা: জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া, আর্থিক স্বচ্ছলতা অর্জন প্রতিটি মানুষের লালায়িত স্বপ্ন। জীবনের প্রথম প্রহর থেকেই সেই স্বপ্নে বড় হতে থাকে প্রতিটি মানুষ।
সমাজে এমন কিছু লোক আছেন যাদের অর্থ সম্পদ, খ্যাতি থাকা সত্ত্বেও ডুকরে ডুকরে কাটিয়ে দিচ্ছেন কোনো আশ্রমে। এমনই একজন ভাগ্য বিড়ম্বনার কথাই বলছি। যিনি জীবনে শিক্ষায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে এক সময় শিক্ষকতা করেছেন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজের মতো করেই। আর্থিক দৈন্যতা কি যার পরিবারে কোনোদিন বোঝার সময় ছিল না। সেই ব্যক্তিই এখন থাকেন প্রবীণ আশ্রয় কেন্দ্রে।
কেঁদে কেদেঁ নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, ওরা আমার সঙ্গে এতো ছলচাতুরি করে কেনো, ওরা আমার এতো কষ্ট দেয় কেনো? এ সময় কোরান-হাদিসের কথা উল্লেখ করে বলেন, বলা আছে সন্তানদের আচরণে বাবা-মা উহ..আহ শব্দ করলেই আল্লাহ সন্তানদের প্রতি নারাজ হন। তারপরেও আমাকে কেনো এভাবে রাখে আল্লাহ।
বলছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক (অব.) ড. এম আব্দুল আউয়ালের (৭০) কথা। দীর্ঘ ১৭ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন সুনামের সঙ্গে। ২০০৬ সালে অবসর নেওয়ার পর থেকেই কিছুদিন ভালোই চলছি অধ্যাপকের।
অধ্যাপক আব্দুল আউয়ালের সংসারে দুই ছেলে, এক মেয়ে। তিন সন্তানের মধ্যে মেয়ে সবার বড়, নাম রেজিনা ইয়াসিন, আমেরিকা প্রবাসী। এরপর বড় ছেলে উইং কমান্ডার (অব.) ইফতেখার হাসান। সবার ছোট ছেলে রাকিব ইফতেখার হাসান অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী।
জীবনে এতো কিছু থাকার পরও আজ তার দু’চোখে অন্ধকার। থাকেন আগারগাঁও প্রবীণ নিবাসে। ঈদের দিন কেমন কেটেছে প্রবীণদের, খোঁজ নিতে নামাজ পরেই যাওয়া হয় প্রবীণ নিবাসে। পাঁচ তলায় উঠতেই দেখি বৃদ্ধ বয়সী এক ভদ্রলোক ভেতর দিয়ে হাঁটা হাঁটি করছেন। সালাম দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এসে বুকে জড়িয়ে ধরেন। বলতে থাকেন চিনতে পারলাম না বাবা। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর রুমের ভেতর নিয়ে বসতে দেন চেয়ারে, এরপর বলতে থাকেন নিজের দুঃখ গাথা জীবনের কথা।
আব্দুল আউয়াল জানান, শিক্ষকতার আগে ১৯৬৫-১৯৮৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ এটমিক এনার্জিতে চাকরি করেছি। এরপর শিক্ষকতা। জীবনে অনেক টাকা-পয়সা উপার্জন করেছি। ২০০৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার সময়ও আমার ২ কোটির বেশি টাকা ছিল। সেসব টাকার মধ্যে কিছু একটি এমএলএম কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে ধরা খাই। এরপর আবার অপরিচিত একজনের আশ্বাসে আফ্রিকা যাওয়ার জন্য ৫০ লাখ টাকা দিয়ে ধরা খাই। তারপর জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। ছেলে-মেয়েরা আমার খোঁজখবর নেওয়া বন্ধ করে দেয়।
কল্যাণপুর হাউজিং এস্টেটে নিজের ফ্ল্যাট ছিল আব্দুল আউয়ালের। এছাড়া পল্লবীতেও বেশ কিছু জমি ছিল। কিন্তু এসব বড় ছেলে কৌশলে বিক্রি করে টাকা পয়সা নিজের অ্যাকাউন্টে জমা করেছেন, আক্ষেপ করেই বলেন অধ্যাপক আউয়াল।
তিনি বলেন, ওরা মাকে এতো কষ্ট দেয় কেনো। আমার নিয়ে এতো ছলচাতুরি করে কেনো? বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে উঠেন অধ্যাপক। তিনি বলেন, আমি কি এই জন্য এতো কষ্ট করে ওদের মানুষ করেছিলাম?
অধ্যাপক আউয়াল বলেন, চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর কিছু দিন বড় ছেলের সঙ্গেই থাকতাম। ছেলের সংসারে থাকার সময় জানতে পারি ছেলে ও বউয়ের মধ্যে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। একদিন বাসায় থাকা অবস্থায় বউয়ের মুখে গালি শুনে বাসা থেকে নেমে আসি। আর ফিরে যাই না। ওরা কেউ খোঁজও নেয় না।
ছোট ছেলে অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে আসে ২০১৪ সালে। এসে আমার সঙ্গে দেখা করার কথা বলে মিরপুর-১ নম্বরে একটি দোকানে। সেখানে গেলে আমাকে জানায় তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমি ওর বাবা অথচ আমাকে জানালোও না যে বিয়ে করতে যাচ্ছে। এতকিছুর পরও যখন বিয়ে করে আবার চলে যাবে অস্ট্রেলিয়া তখন আমি বউ মাকে দোয়া করতে চাইলে দেখা করা যাবে না বলে জানায় ছেলে। অথচ এই ছেলের পড়ালেখার জন্যও পেনশনের টাকা থেকে ২৬ লাখ পাঠাই। সেই ছেলেও আমাকে কোনোদিন ফোন করে না। মাঝে মাঝে ইমেইলে চিঠি লেখে।
অধ্যাপক আউয়ালের ক্ষোভটা বড় ছেলের দিকে। তিনি বলেন, আমার অন্য সন্তানদের চাইতে বড়টা একটু বেশি চতুর। ওই সব কল-কাঠি নাড়াচ্ছে। আমার সব টাকা ওই বিভিন্ন সময় নিয়েছে। এখনো ওর কাছে ৬০ লাখ টাকা পাই। সেই টাকা দিচ্ছে না। আমি উকিলের মাধ্যমে টাকা চেয়ে পাঠাই, ছেলে বলেছে তার কাছে কোন টাকা নাই।
তিনি বলেন, আজ ঈদের দিন, অথচ কেউ নেই আমার কাছে। আমার চারটা নাতিন। ওদের কারো মুখটা দেখতে পারছি না। এই কথা বলে আবারও কাঁদতে থাকেন অধ্যাপক আউয়াল। মনের ক্ষোভে বলতে থাকেন, টাকা যদি নাই দেয় তাহলে আমার ছেলেকে আমি ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করবো।
অধ্যাপক (অব.) ড. এম আব্দুল আউয়াল থাকেন আগারগাঁও প্রবীণ নিবাসের ৫ম তলার ৫০২ নম্বর কক্ষে। ঈদের দিন সকালে প্রবীণ নিবাস থেকে পরটা, সেমাই, পায়েস দিয়েই সেরেছেন সকালের নাস্তা।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৫ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৫
এসএম/জেডএস