ঢাকা, সোমবার, ১১ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৪ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

রেললাইন যেন মাদকের হাট!

হাসিবুর রহমান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৫
রেললাইন যেন মাদকের হাট! ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: ‘মামা কী খাবেন? ঘরে আসেন। সবকিছুর ব্যবস্থা আছে।

ফয়েল, সুঁই সব আছে। খান, এরপর খুশি হয়ে যা দেন। ’ রাজধানীর কারওয়ান বাজারের মাছের আড়তের পাশের রাস্তা দিয়ে রেললাইনে প্রবেশ করে কাভার্ড ভ্যানের স্ট্যান্ড ঘেঁষে শুটকি পট্টির পেছনে পৌঁছাতেই এক মাদক বিক্রেতার এমন আহ্বান পাওয়া গেল।

রাত ১০টার কথা। ‘কী?’ বলে প্রশ্ন করতেই আহ্বানকারীর জবাব, ‘মামা খাবেন তো? বড়টা আছে, ৩০০ দিয়েন। মামা আহেন, কোনো ঝামেলা নাই, আমার ঘরের কাছে কেউ আইব না। ’

ডাকতে ডাকতেই সর্বনাশা মাদক ইয়াবা সেবনের জন্য প্রতিবেদককে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার বর্ণনা দিচ্ছিলেন বিক্রেতা। কথা তখনও শেষ হয়নি। নাম জানতে চাইতেই উত্তর, ‘ইস্পিশাল রনি, এই নাম কইলেই হবে, যেকুনু সময় দরকার অইলে আইয়া পড়বেন। ’

কেবল ‘ইস্পিশাল রনি’ই নন, নারী-পুরুষ মিলিয়ে অর্ধশতাধিক মাদক বিক্রেতা রয়েছে কারওয়ান বাজারের মাছের আড়ত থেকে শুরু করে শুটকি পট্টি হয়ে কাভার্ড ভ্যান স্ট্যান্ড পর্যন্ত। এ এলাকায় সন্ধ্যার পর যেন মাদকের হাট বসে। রেললাইনের দু’পাশের ছোট ছোট ঝুঁপড়ি ঘরগুলোকে আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করে মাদক ব্যবসায়ীরা।

রেলের জায়গায় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব আস্তানার (বস্তির) সামনেই প্রতিদিন গাঁজা, ইয়াবা, হেরোইন আর ফেনসিডিলের পসরা সাজিয়ে বসে মাদক ব্যবসায়ীরা। একইসঙ্গে থাকে ভাসমান দেহ পসারিনী।

আগন্তুক দেখেই নারী গাঁজা বিক্রেতারা ডাকছিল, ‘কয় ট্যাহার লাগবো? একশ’ না দুইশ?’ জানা গেল, এরা হেরোইন বা ফেনসিডিল সাধারণত সঙ্গে রাখে না, চাহিদার পরিমাণ জানালে তবেই নিয়ে আসে।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড় মাদকের বাজার। কারওয়ান বাজার মাছের আড়ত থেকে শুরু করে তেজঁগাও রেলক্রসিং পর্যন্ত রেললাইনের পাশে গড়ে ওঠা এ বাজারে প্রতিদিন লেনদেন হয় প্রায় অর্ধকোটি টাকার মাদকের। আর এ টাকায় ভাগ বসান পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা। এসব অসাধু কর্মকর্তাদের যোগ সাজশেই মাদক ব্যবসা পরিচালনা করা হয় এখানে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এবং অনুসন্ধানে জানা যায়, এ এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান চালালেও মাদক ব্যবসায়ীরা ধীরে ধীরে আবার ফিরে আসে। অবস্থানগত দিক থেকে মাদক বিক্রি, সংগ্রহ ও পালানোতে সুবিধা থাকার কারণে মাদক ব্যবসায়ীরা এই এলাকা ত্যাগ করতে চায় না। টেকনাফ থেকে রেলের মাধ্যমে আসা ইয়াবার চালান বস্তির মধ্যে নামানো যেমন সহজ, তেমনি থাকে পুলিশের অভিযানের খবর মিললে মুহূর্তের মধ্যেই কারওয়ান বাজার, হাতিরঝিল, তেজগাঁওসহ বিভিন্ন দিক দিয়ে সহজেই ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে যাওয়ার সুযোগ।

তাছাড়া, বস্তির বিভিন্ন দিক দিয়ে যাওয়া-আসার ব্যবস্থা থাকায় এখানে ক্রেতাও বেশি। ক্রেতাদের মধ্যে কারওয়ান বাজারে আসা বাস-ট্রাকের শ্রমিক, আশেপাশের এলাকার বাসিন্দা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে খুচরা মাদক বিক্রেতারাও। আবার এখানে দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার মাদকসেবীদেরও প্রধান লক্ষ্য থাকে এখান থেকে মাদক সংগ্রহ করা।

এসব বিষয়ে তেজগাঁও জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) বিপ্লব কুমার সরকার বাংলানিউজকে জানান, মাদক ব্যবসার এ বাজারে প্রতিদিনই অভিযান চালায় পুলিশ, আটককৃতদের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সাজাও দেওয়া হচ্ছে, তবে মূল সমস্যা হল বস্তি। বস্তি উচ্ছেদ করতে না পারলে এ ব্যবসা পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব নয়।

যদিও এ পুলিশ কর্মকর্তার দাবির সঙ্গে বাস্তবতার মিল সামান্যই বলে দেখা যায়। কারওয়ান বাজার মাছের আড়তের পাশের প্রবেশমুখে দেখা গেল একটি পুলিশ পিকআপ ভ্যান। ভ্যানের বাইরে দাঁড়িয়ে খোশ গল্পে মশগুল তিন পুলিশ সদস্য। তাদের সামনে দিয়েই প্রতিবেদক রেললাইনে প্রবেশ করলেও কোনো প্রকার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। ও প্রান্তে কাভার্ড ভ্যান স্ট্যান্ড মোড়েও দেখা গেল একই দৃশ্য। পুলিশের উপস্থিতিতেই ঘটছে সবকিছু, কিন্তু তারা দেখেও না দেখার ভান করে আছেন। আর যদি কাউকে আটক করেনও, তবে দেখা যাচ্ছে, সে মাদক ব্যবসায়ী নয়, মাদকসেবী।

পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কে কারওয়ান বাজারের মাছের আড়তদার মো. ইব্রাহীম বাংলানিউজকে বলেন, ‘পুলিশ কী করে দ্যাখবে বলেন, তারা তো এগো (মাদক বিক্রেতা) কাছ থেইকে পতিদিন টাহা পাচ্ছে। আবার মাঝেমধ্যি যে বেচে, সে-ই আবার পুলিশকে ফোন করে ক্রেতাকে ধরিয়ে দেয়। তহন পুলিশ এসব মাদক ক্রেতাদের নানা ভয়-ভীতি দেখিয়ে টাকা-পয়সা, মোবাইল-ফোন যা পায় হাতায় নেয়। ’

রেলের জায়গায় মাদক ব্যবসার আস্তানা গড়ে ওঠা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে লাভ হয় না, কিছুদিনের মধ্যেই আবার সব ফেরত আসে। এখনই আসলে স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। আগামী বছরের শুরুর দিকে নতুন রেললাইনের কাজ শুরু হবে, তখন রেললাইনের বেদখল হওয়া জায়গা উদ্ধার করে সীমানা প্রাচীর দিয়ে দেওয়া হবে। ’

গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর কারওয়ান বাজার রেললাইনে দুর্ঘটনায় চারজন নিহত হওয়ার ঘটনার পরদিন বস্তি উচ্ছেদ অভিযান চালায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তবে এ বছরের জানুয়ারির হরতাল-অবরোধের সময় থেকে একে একে মাছের আড়ত, মাদক ব্যবসা সবই ফিরে এসেছে এখানকার রেললাইন ঘেঁষে।

বাংলাদেশ সময়: ১০০৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৫
এইচআর/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।