ঢাকা, রবিবার, ১০ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

বাস্তবসম্মত ড্যাপ ও স্ট্রাকচার প্ল্যান তৈরি করতে হবে

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৫
বাস্তবসম্মত ড্যাপ ও স্ট্রাকচার প্ল্যান তৈরি করতে হবে ছবি: শোয়েব মিথুন- বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ১৯৯৫-২০১৫ (ড্যাপ) যারা প্রণয়ন করেছেন, তারা আসলে জায়গাটিই দেখেননি। ঘরে বসে গুগলে লাইন টেনে ড্যাপ করা হয়েছে।

যে কারণে ড্যাপে নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয়েছে। জনগণও এ নিয়ে অনেক হইচই করেছে। তাই সবার মতামতের ভিত্তিতে সমন্বিতভাবে বাস্তবসম্মত ড্যাপ ও স্ট্রাকচার প্ল্যান তৈরি করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সব জনপ্রতিনিধি ও প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করে সমন্বিতভাবে এক বছরের মধ্যে বাস্তবসম্মত ও যুগোপযোগী ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান বা কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ২০১৫-৩৫ সালের জন্য খসড়া ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান বা কৌশলগত পরিকল্পনা নিয়ে দু’দিনব্যাপী জাতীয় সেমিনারে এ কথা বলেন গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন।

এতে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ছাড়াও ঢাকা সিটির দুই মেয়র, গাজীপুরের ভারপ্রাপ্ত মেয়র ও নারায়ণগঞ্জের মেয়রসহ বিভিন্ন আবাসন ব্যবসায়ীর পক্ষ থেকে জোরালোভাবে আগামী ২০ বছরের জন্য প্রণয়ন করা স্ট্রাকচার প্ল্যানটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়।

এ সময় উপস্থিত বক্তারা বাস্তবায়নযোগ্য, সরেজমিন পরিদর্শন, স্থানীয় প্রতিনিধি, সিটি করপোরেশনের মেয়র, স্টেকহোল্ডার, আবাসন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় করে পরিকল্পনাটি চূড়ান্ত করার ওপর জোর দেন। এ জন্য কমপক্ষে এক বছর সময় দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। বিশাল আয়তনের একটি প্ল্যান কয়েক দিনেই শেষ করতে গেলে তা আগের ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) মতোই ক্রটিপূর্ণ হবে, যা বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে হাজার হাজার প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে-এমন দাবিও উঠে আসে বক্তাদের পক্ষ থেকে।
Conference_anichur
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক বলেন, ২০১০ সালে ত্রুটিপূর্ণ ড্যাপ নিয়ে জনতার আন্দোলন হয়েছে, তা আমরা সবাই দেখেছি। মানুষ যখন স্থাপনা করে বসে আছে তখন আমরা গেলাম ‘ড্যাপ’ নিয়ে। ড্যাপে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান সরানোর কথা বলা হয়েছে। তাই আগের ড্যাপে কী ধরনের ত্রুটিবিচ্যুতি ছিল তা বের করে সমাধান করুন। ড্যাপে ৬১ শতাংশের ওপরে কনজারভেশন জোন রাখা সম্ভব কি না তা ভেবে দেখুন। নতুন যে পরিকল্পনাটি দেওয়া হয়েছে, আগে ঠিক করুন সেটি কবে বাস্তবায়িত হবে। এ ছাড়া সাভার-আশুলিয়া এলাকায় গার্মেন্টশিল্প স্থাপনের নকশা অনুমোদন আটকে রাখা হয়েছে। আমি প্রস্তাব দিচ্ছি, সব নদী উদ্ধার করার জন্য একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হোক।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, রাজধানীর গণ্ডির মধ্যে রাজউকের কার্যক্রম পরিচালনা করার কথা থাকলেও রাজউক গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ এলাকায়ও কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ক্ষমতা ও দায়িত্বের অতিরিক্ত কার্যক্রম পরিচালনা করায় নগর ব্যবস্থাপনায় চরম ব্যর্থতা ফুটে উঠছে রাজউকের। সমন্বিতভাবে আমরা যদি ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা করতে পারি, তাহলে ঢাকাকে বাসযোগ্য করে গড়ে তোলা সম্ভব হবে। নইলে এর খেসারত দিতে হবে যুগ যুগ ধরে।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াত আইভী বলেন, আমরা কি শুধু পরিকল্পনা করব; নাকি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করব। নারায়ণগঞ্জের পরিকল্পিত উন্নয়নে সরকার ও রাজউকের ইতিবাচক কার্যক্রম প্রত্যাশা করি। তিনি শীতলক্ষ্যার পারে ওয়াকওয়ে নির্মাণ ও বনায়ন করার ওপর জোর দেন।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণ, ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যানের আয়তন হলো ১৬২৪ বর্গকিলোমিটার। আমি এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। অল্প সময়ের মধ্যে এই প্ল্যানের সব কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখা সম্ভব হয়নি। প্রণীত প্ল্যানে প্রচুর ত্রুটিবিচ্যুতি রয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হলো। ড্যাপও ঘরে বসে করা হয়েছিল। নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণয়নকৃত কাঠামোগত পরিকল্পনা, যা ওই এলাকার উন্নয়নের জন্য প্রণীত হয়। প্ল্যানের মেয়াদ ২০-২৫ বছর হয়ে থাকে। গাজীপুর একটি নবগঠিত সিটি করপোরেশন। এর আয়তন ৩২৯.৫৩ বর্গকিলোমিটার এবং লোকসংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ। ঢাকার অতি সন্নিকটে হওয়ায় গাজীপুর মহানগরীকে সুন্দর ও পরিকল্পিতভাবে সাজানো প্রয়োজন।

বসুন্ধরা গ্রুপের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার আবুল কালাম শামিম বলেন, যেকোনো পরিকল্পনা করা হয় জনসাধারণের উপকারের জন্য। কিন্তু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গেলে জনগণের একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর অন্য অংশ লাভবান হয়। যে অংশটি কনজারভেশন জোন হিসেবে ঘোষণা করে ২০ বছরের জন্য আটকে দেওয়া হয় তা সংশ্লিষ্টদের জন্য চরম বৈষম্যমূলক। এর একটা যৌক্তিক সমাধান হওয়া উচিত। যদি কোনো এলাকাকে কনজারভেশন জোন হিসেবে ঘোষণা করা হয়ে থাকে তাহলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে সমাধানে আসা উচিত। দায়সারাভাবে এ ধরনের ঘোষণা বছরের পর বছর ধরে শুধু লোকজনকে ভোগান্তিতে ফেলবে।

এ ছাড়া এ খসড়ার ভুল অংশ নিয়ে রাজউকে হাজার হাজার আবেদন পড়েছে। এগুলোর ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না। নতুন ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যানেও বিশাল এলাকাজুড়ে কনজারভেশন জোন ঘোষণা করা হয়েছে। আশা করব সর্বসম্মতিক্রমে আলোচনার ভিত্তিতে এ প্ল্যান চূড়ান্ত করা হবে।

রিজিওনাল ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানিংয়ের (আরডিপি) টিম লিডার জিন কো চো বলেন, উন্নত বিশ্বের আদলে রাজধানী ঢাকাকে গড়ে তুলতে একটি সুন্দর পরিকল্পনার কোনো বিকল্প নেই। রাজউক রাজধানীকে বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে সেই ধরনের পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী শহর গড়ে তুলতে পারলে ঢাকা একটি আধুনিক শহরে পরিণত হবে। রাজউকের পূর্বাচলকে তিনি একটি পরিকল্পিত শহর হিসেবে গড়ে তোলার কথাও উল্লেখ করেন।

রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী জি এম জয়নাল আবেদিন ভূঁইয়া বলেন, ড্যাপে যে ধরনের ভুলত্রুটি ছিল তা আমরা ঠিক করে নেব। কারণ মানুষের উপকারের জন্য পরিকল্পনা করে তা ভোগান্তির কারণ হিসেবে উঠে আসবে তা উচিত নয়। আজকের সেমিনারে যেসব প্রস্তাবনা পেয়েছি তা আমরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করব।

বুয়েটের অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, যেকোনো রাজধানীর তুলনায় আমাদের শহরে যোগাযোগব্যবস্থা অপ্রতুল। রাজধানীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তেও আসা যায় যদি ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা ভালো থাকে। তুলনামূলকভাবে মিরপুরে লোকজন বেশি থাকে। কারণ মিরপুর থেকে গুলিস্তানে সহজেই যাতায়াতের জন্য গাড়ি পাওয়া যায়। তাই ভালো বাস সার্ভিসের ব্যবস্থা করতে পারলে নাগরিক জীবনে অনেকটা স্বস্তি দেওয়া যাবে। ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যানে গণপরিবহনের বিষয়টি সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে।

বুয়েট অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমদ আনসারী বলেন, যেকোনো পরিকল্পনায় ভূমিকম্প ও অগ্নিকাণ্ডকে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ মাটির নিচ দিয়ে গ্যাসের লাইন থাকলে ভূমিকম্পের কারণে আগুনের ঘটনা ঘটে। ঢাকা শহরে সহনীয় মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হলে অনেক ভবন ভেঙে পড়বে। সে সময় উদ্ধারকাজ চালানোর জন্য সুযোগ পাওয়া যাবে না। এ জন্য ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যানে ভূমিকম্পকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

সেমিনারে ‘খসড়া ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান’এর সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম। এতে বিভিন্ন আবাসন ও ডেভেলপার কম্পানির প্রতিনিধিরাও অংশগ্রহণ করে প্ল্যানের ব্যাপারে নানা যৌক্তিক পরামর্শ তুলে ধরেন। তা চূড়ান্ত প্ল্যানে নিয়ে আসার ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্তদের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৫
জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।