ঢাকা, শনিবার, ৯ ফাল্গুন ১৪৩১, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২২ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

ঝোপ বুঝে কোপ মারেন অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা

জান্নাতুল ফেরদৌসী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৩১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৫
ঝোপ বুঝে কোপ মারেন অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা ছবি: প্রতীকী

ঢাকা: কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে ‍অভিনব কৌশলে প্রতিদিনই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে বেড়াচ্ছেন অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা।

সাধারণত লোক বুঝে শিকারকে টার্গেট করে থাকেন তারা।

মওকা পেলেই ঝোপ বুঝে কোপ মারেন!

কোরবানি ঈদের সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের অপকর্মের বলি হন সাধারণ পশু ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি পাবলিক বাসের যাত্রীদের আচার ও নানা খাবার খাইয়ে অজ্ঞান করে তাদের সর্বস্ব নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। গত বছরও অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের অপতৎপরতায় মৃত্যু হয় ছয়জনের।

তাদের প্রতিরোধ করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তরফে নানা তৎপরতার কথা শোনা গেলেও, তাদের কবল থেকে যেন নিস্তার নেই সাধারণ মানুষের।

মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) দেওয়া তথ্যমতে, গত কয়েকমাসে গরু-ছাগলের হাটসহ রাজধানীর নানা স্থান থেকে প্রায় অর্ধশত অজ্ঞান পার্টির সদস্যকে আটক করেছেন তারা। তারপরও কমছে না অজ্ঞান পার্টির কার্যক্রম।

জানা গেছে, অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের আটক করা হলেও, এ ধরনের মামলা দুর্বল হওয়ায় অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যান দ্রুত।

দুর্বৃত্তদের নানা কৌশল
রাজধানীর কয়েকটি থানায় কর্মরত পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কীভাবে অভিনব কৌশলে মানুষের সর্বস্ব ছিনিয়ে নিয়ে থাকেন অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা।

রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা (ওসি) মো. মোরশেদ বাংলানিউজকে জানান, সাধারণত অজ্ঞান পার্টি বা মলম পার্টির সদস্যরা পাঁচ থেকে ছয়জন করে থাকেন একেকটি দলে। কোরবানির হাটে প্রথমে কোনো একজনকে টার্গেট করে তার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন। এরপর বিভিন্ন খাবারের মধ্যে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে তাকে খাইয়ে অজ্ঞান করার চেষ্টা করেন।

কাফরুল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. শহিদুল্লাহ বাংলানিউজকে জানান, যাত্রী বেশে গাড়িতে উঠে যাত্রীদের পাশে বসে আচার, চানাচুর, বিস্কুটসহ নানা খাবার খাইয়ে অজ্ঞান করেন দুর্বৃত্তরা। এরপর মালপত্র ও টাকা-পয়সা নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়েন। অনেকে আবার লজেন্স, আচার বিক্রেতা সেজেও এ ধরনের অপরাধ করে থাকেন।  

এ সম্পর্কে ডিবির পরিদর্শক নিবারণ চন্দ্র বাংলানিউজকে জানান, রাস্তার ফুটপাতে মলমের দোকান দিয়ে বসেন অজ্ঞান পার্টির এক সদস্য। অন্যরা পাশ দিয়ে হাঁটতে থাকেন। সাধারণ মানুষের কাছে মলম বিক্রির সময় চক্রের একজন সেখানে দাঁড়িয়ে মলম কেনার ভান করেন। পরে শিকারের চোখে মলম লাগিয়ে অজ্ঞান করে সর্বস্ব ছিনিয়ে পালিয়ে যান তারা। তবে সাধারণত গ্রাম থেকে আসা মানুষই থাকে তাদের টার্গেট।

এছাড়া অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের অপকর্মের অন্যতম টার্গেটে থাকেন ট্রেন যাত্রীরা। এ সম্পর্কে কথা হয় কমলাপুর রেলস্টেশন থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) রফিকুল ইসলামের সঙ্গে।

তিনি জানান, প্রথমেই তারা যাত্রীদের সঙ্গে খাতির জমানোর চেষ্টা করেন। এরপর যাত্রীর আস্থা অর্জন করে তাকে পান, জুস, ক্রিম বিস্কুট, চানাচুরসহ বিভিন্ন খাবার সাধেন।

পরে ওই গ্রুপের আরেক সদস্য টার্গেট করা যাত্রীর কাছে হকার সেজে খাবার বিক্রি করতে আসেন। সেই খাবারে আগে থেকেই অতিরিক্ত মাত্রায় ঘুমের ওষুধ মেশানো থাকে। খাওয়ার পর যাত্রী অজ্ঞান হয়ে গেলে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে তাকে অন্যত্র নিয়ে টাকা-পয়সা নিয়ে পালিয়ে যান চক্রের সদস্যরা।

এছাড়া মানুষকে ফাঁদে ফেলতে নিত্যনতুন কৌশল উদ্ভাবন করছেন অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। অজ্ঞান পার্টির কৌশল যে দিন দিন পরিবর্তন হচ্ছে, তার একটি বড় প্রমাণ মেলে কিছুদিন আগে প্রকাশিত এক সংবাদে।

গত ২০ আগস্ট রমনা থানার মালিবাগ থেকে পরিকল্পনাকারীসহ অজ্ঞানপার্টির ছয় সদস্যকে আটক করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। হজে গিয়ে হজযাত্রীদের ফাঁদে ফেলার পরিকল্পনা করছিলেন তারা।

এমনকি এজন্য গ্রুপের পরিকল্পনাকারী ১২ লাখ টাকা বিনিয়োগও করেন। তাদের টার্গেট ছিল, এবারের হজ থেকে অন্তত এক কোটি টাকা আয়ের।

সর্বশেষ গত ৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় অভিযান চালিয়ে অজ্ঞান পার্টি চক্রের সদস্য সন্দেহে ১৯ জনকে আটক করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)।

এভাবেই দিন দিন কৌশল পরিবর্তন করে মানুষকে প্রতারিত করে চলেছেন অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা।  

ডিএমপির পরিসংখ্যান
ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারের দেওয়া তথ্য মতে, গত বছরের জুন থেকে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত অজ্ঞান ও মলম পার্টি সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা ১০টি। এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত অজ্ঞান পার্টি সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা ৩টি। মামলাগুলো হয়েছে কোতোয়ালি, যাত্রাবাড়ী ও মোহাম্মদপুর থানায়।

ফেব্রুয়ারি মাসের ১৫ তারিখ থেকে মার্চ মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত কলাবাগান, রূপনগর ও উত্তরা-পূর্ব থানায় অজ্ঞান পার্টি সংক্রান্ত মোট ৩টি মামলা হয়েছে। এরপর এপ্রিল মাসে যাত্রাবাড়ি থানায় ১টি, কলাবাগান থানায় ১টি ও উত্তরা-পশ্চিম থানায় ১টি অজ্ঞানপার্টির মামলা হয়েছে।

এ পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যাচ্ছে, প্রতি মাসেই প্রায় অজ্ঞানপার্টির ১টি অথবা ২টি করে গ্রুপ আটক হয়। আর ঈদের আগে তো প্রায় প্রতিদিনই অজ্ঞান পার্টির কোনো না কোনো সদস্যকে আটক করে পুলিশ।

এ সম্পর্কে গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, রাজধানীর বাসস্ট্যান্ড, সদরঘাট, ফেরিঘাট ও গরুর হাটসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অজ্ঞানপার্টির সদস্য তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন। তবে গত বছরের তুলনায় এ বছর তাদের সংখ্যা কমেছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের আটক করতে আমাদের কয়েকটি টিম কাজ করছে। এছাড়াও বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।

তবে এ ধরনের অপরাধীদের হাত থেকে বাঁচতে গরু ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ কিংবা যাত্রীদেরও সতর্ক থাকতে হবে বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ০১৩৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৫
জেডএফ/এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।