বৈশ্বিক বিভিন্ন সূচকে সবচেয়ে খারাপ বা বসবাস অনুপযোগী শহরগুলোর একটি হচ্ছে ঢাকা মহানগর। ঘিঞ্জি পরিবেশ, জলাবদ্ধতা, যানজট, বায়ুদূষণ, পার্ক বা খেলার জায়গা না থাকাসহ নানাবিধ সমস্যা নিয়ে চলছে এখানে নাগরিক জীবন।
*ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান (২০১৬-২০৩৫) নিয়ে আপনার অভিমত কী?
*ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন: আমরা একটি বাসযোগ্য নগরী গড়ে তোলার লক্ষ্যেই ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান করতে চাই। তবে এ প্ল্যান সম্পূর্ণ বাস্তবতার নিরিখে করা হবে। রাজউক প্রতিটি জায়গায় গিয়ে সার্ভে করে কাজ করবে। এখানে ঘরে বসে করা কোনো প্ল্যান কাজে আসে না। আগে যারা ড্যাপ প্রণয়ন করেছেন তারা আসলেই সরেজমিন ঘুরে দেখেননি। গুগলে লাইন টেনে এ ড্যাপ করা হয়েছিল। যেখানে বাড়িঘর সেখানে পানি, আর যেখানে-সেখানে বিল্ডিং ভেঙে রাস্তা দেখানো হয়েছিল। এ কারণে ড্যাপ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তাই সবার মতামতের ভিত্তিতে সমন্বিতভাবে বাস্তবসম্মত ড্যাপ (ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান) ও ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান তৈরি করতে চাই; যে প্ল্যানের আদলে ঢাকা একটি ভালো শহরে রূপ নেবে।
*খসড়া ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মতামত চাওয়া হয়েছে। সেখানে রাজউকে শত শত আপত্তি ও অভিযোগ পড়েছে প্ল্যান নিয়ে। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, রাজউক অনেক যৌক্তিক আপত্তিও আমলে না নিয়ে প্ল্যান চূড়ান্ত করতে এগিয়ে যাচ্ছে।
*ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন: আমরা প্ল্যান করতে চাই মানুষের কল্যাণে। তাই মানুষের আপত্তি বা আবেদন তো বিবেচনায় নিতেই হবে। গণমানুষের দাবি উপেক্ষা করে প্ল্যান করে তো কোনো লাভ নেই। তাহলে এ প্ল্যান কাগজে-কলমে থেকে যাবে। তাই সবার সমন্বয়ে প্ল্যান চূড়ান্ত করার ব্যাপারে আমাদের নির্দেশনা রয়েছে।
*কনজারভেশন জোনের নামে মানুষের হয়রানি হবে কি না?
*ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন: কনজারভেশন জোনে পার্ক, লেক, পানিপ্রবাহের স্থান রাখা হয়েছে। একটা শহরের সব স্থানে যদি বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়, তাহলে মানুষ নিঃশ্বাস নেবে কীভাবে। তাই আমরা কনজারভেশন জোন রেখেছি। তবে কনজারভেশন জোন নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যেন কোনো ধরনের সমস্যায় না পড়ে, সেদিকে আমরা নজর রাখব।
*ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান চূড়ান্ত করতে কেমন সময় লাগবে?
*ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন: খসড়া প্ল্যানটি চূড়ান্ত করার জন্য সংশ্লিষ্ট সব জনপ্রতিনিধি ও প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভূক্ত করতে বলা হয়েছে রাজউককে। আশা করছি, এক বছরের মধ্যে সমন্বিতভাবে বাস্তবসম্মত ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান প্রণয়ন করা সম্ভব হবে। তবে এ ক্ষেত্রে কিছুটা সময় বেশি লাগলেও তা আমরা আমলে নেবো।
*রাজউকের পূর্বাচল উপশহর কতোটা আধুনিক হবে বলে মনে করেন?
*ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন: পূর্বাচলকে একটি আধুনিক স্মার্ট সিটি করার জন্য আমরা সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। সেখানে পর্যাপ্ত জলাধার ও উন্মুক্ত স্থান রাখা হবে। পূর্বাচলে প্রায় ৪৮ বর্গকিলোমিটার লেক রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ড্রেনেজ, স্যুয়ারেজসহ সব ইউটিলিটি সার্ভিস হবে উন্নত বিশ্বের শহরের মতো। আমরা পূর্বাচলের ক্ষেত্রে বিশেষ করে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করার ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়েছি।
*প্রধানমন্ত্রী গত ২৮ ডিসেম্বর আপনার (পূর্ত মন্ত্রণালয়) মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় গণপূর্ত বিভাগ ছাড়া অন্য কোনো সরকারি দফতর নিজেরা স্থাপনা নির্মাণ করতে পারবে না- এমন একটি কথা বলা হয়েছিল। এ প্রস্তাবের ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
*ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন: বড় বড় সরকারি ভবন আমাদের পূর্ত থেকে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তবে সরকারি অন্য সব দফতরের ছোট ছোট প্রকৌশল দফতর রয়েছে। তারা ভালো মানের কাজের ব্যাপারে এতটা দক্ষ না। যেমন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নতুন বার্ন ইউনিট করবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েরও একটি ছোট প্রকৌশল দফতর রয়েছে। তারা এত বড় কাজ করতে পারবে না। গণপূর্তের আওতায় কীভাবে সব দফতর আনা যায়, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা কাজ করছে।
*রানা প্লাজা ধসের পর সরকারি সিদ্ধান্ত হলো, রাজউকের অন্তর্ভূক্ত এলাকায় অন্য কোনো সরকারি সংস্থা নিজেরা নকশা অনুমোদন করে স্থাপনা নির্মাণ করতে পারবে না। কিন্তু এ বিধি অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানই মানছে না। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
*ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন: আশুলিয়ার দিকে আরএমজি ফ্যাক্টরিগুলো করার জন্য নির্ধারিত স্থানে রাজউক বাস্তবে গিয়ে দেখে তা অনুমোদন দেবে। সিটি করপোরেশন বা অন্য সংস্থা নিজেরা কোনো নকশা অনুমোদন করে স্থাপনা নির্মাণ করতে পারে না। এমনকি গণপূর্ত বিভাগ যেসব ভবন নির্মাণ করবে তা-ও রাজউক থেকে অনুমোদন করাতে হবে। কারণ স্ট্রাকচারাল ডিজাইন ঠিকমতো হলো কি না তা রাজউক নিশ্চিত করবে।
*হাতিরঝিলে দুর্গন্ধ কিছুতেই কাটছে না কেন?
*ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন: রাজধানীর দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা হাতিরঝিলকে দূষণমুক্ত রাখতে ওয়াসার স্যুয়ারেজ লাইন সরিয়ে নেওয়া হবে। কিন্তু সোনারগাঁও হোটেলের পাশের কালভার্টের অংশ থেকে স্যুয়ারেজের ময়লা হাতিরঝিলে ঢুকছে। আশার ব্যাপার হলো, ঢাকা ওয়াসা একটি প্রকল্পের মাধ্যমে দাশের কান্দিতে স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট বসানোর কাজ শুরু করেছে। এটা শেষ হলেই হাতিরঝিলে আর বর্জ্য প্রবেশ করবে না।
*বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীদের জন্য ‘সিঙ্গেল ডিজিট’ সুদে ঋণ দেওয়ার একটা কথা আপনি দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন। এর অগ্রগতি কতটুকু?
*ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন: সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণের কথা আমি সব সময়ই বলে আসছি। কারণ মানুষের কাছে টাকা না থাকলে তারা ফ্ল্যাট কিনতে পারবে না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতি আমার আহ্বান থাকবে তারা যেন সব ধরনের ক্রেতাদের টার্গেট করে বাসস্থান তৈরি করে। শুধু কোটি টাকার ফ্ল্যাট নির্মাণ করলে এর ক্রেতা পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে।
*নদী ও খাল উদ্ধারে গঠিত টাস্কফোর্সের সদস্য আপনি। এ ক্ষেত্রে অবৈধ দখল-দূষণমুক্ত করার কোনো পরিকল্পনা আছে কি না?
*ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন: আমাদের ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর দিকে তাকালে মন খারাপ হয়ে যায়। নদীগুলো ভরাট করে কেউ কেউ শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছে। আবার ট্যানারির বর্জ্যের কারণে নদী দূষিত হচ্ছে। ওয়াসার ড্রেনেজ ও স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা ঠিকমতো না থাকায় নদীদূষণ বাড়ছে। পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা করতে গেলে ড্রেনেজ ও স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা ভালো থাকতে হবে। নগরবাসীকে আরও সচেতন হতে হবে। যত্রতত্র বর্জ্য ফেলা হলে কীভাবে একটি শহর পরিষ্কার থাকবে? আমাদের সিটি করপোরেশনের পক্ষে প্রতিদিন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা এই বিশাল আবর্জনার স্তূপ পরিষ্কার করা সম্ভব নয়। সরকারিভাবে যে নদীর পিলার দেওয়া হয়েছে তা ঠিক হয়নি। তারা এতো ছোট আকারের নদী পেল কীভাবে? পিলারের কারণে তো নদী আরও সংকুচিত হয়েছে। নদীপথ ড্রেজিং করে দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবে।
*আবাসন সমস্যার সমাধানে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর যে অবদান সে সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
*ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন: আমাদের দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর আবাসনের ব্যবস্থা সরকার বা সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠান একা করতে পারবে না। এজন্য বেসরকারি আবাসন সংস্থাগুলোর সহযোগিতা খুবই দরকার। তারা ইতোমধ্যে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আবাসন নির্মাণ করে এ ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রেখেছে। জলধারা, বসতি অনুযায়ী বিদ্যালয়, হাসপাতাল, পার্কসহ পরিকল্পনা করে এলেই আমরা বেসরকারি আবাসন প্রকল্পের অনুমোদন দিয়ে দেবো।
*আবাসন খাতের কিছুটা স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। তা কাটানোর ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগ সম্ভব কি না?
*ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন: আবাসন খাতে অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগসহ বেশ কিছু সুযোগ রয়েছে। আমার মতে, এ খাতে সরকারের ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দেওয়া দরকার। সহজ শর্তে ফ্ল্যাট কিনতে পারলে আমাদের দেশ থেকে বাইরে অর্থপাচার হবে না।
*রাজউক থেকে ২০ বছরের অনুমোদন নিয়ে কিছু বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠান তাদের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যানে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে কি?
*ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন: আমাদের প্ল্যানে কোনো প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা নয়। কনজারভেশন জোন এলাকা হলে তারা প্রকল্পে পরিমাণমতো পার্ক, পানি নিষ্কাশনের জায়গা রেখে দিলে তো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আমাদের প্ল্যান কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য নয়।
*আগামী ৫ অক্টোবর বিশ্ব বসতি দিবস। এবারের দিবসে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য আবাসন নিয়ে সরকারের কোনো পরিকল্পনা আছে কি?
*ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন: সব মানুষের জন্য বাসস্থান নিশ্চিত করতে বর্তমান সরকার কাজ করছে। উচ্চ আয়ের মানুষের পাশাপাশি আমরা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ফ্ল্যাট প্রকল্প হাতে নিয়েছি। বিদেশি সহযোগিতায় রাজধানীর ভাসানটেকে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। সেখানে বস্তিবাসীরাও ফ্ল্যাট পাবে। খুব সামান্য মাসিক ভাড়া দিয়ে তারা একটি নির্দিষ্ট সময় পর ফ্ল্যাটের মালিক হয়ে যাবে। জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
*জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের ১৪৮ একর জায়গা আছে মিরপুরের ৯ নম্বর সেকশনে। এটা নিয়ে সরকারের কোনো পরিকল্পনা আছে?
*ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন: আমি ২০০১ সালে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ (এনএইচএ) প্রতিষ্ঠা করি। সে সময় প্রতিষ্ঠানটি কিছু কাজ হাতে নিলেও পরে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসার পর তারা এ প্রতিষ্ঠানের বিষয়টি বুঝতে পারেনি। তাই কাজে স্থবিরতা চলে আসে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এনএইচএ বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে। রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও মিরপুরে রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট প্রকল্প। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানের প্রায় অর্ধশত প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। আমরা শুধু মিরপুরের ‘স্বপ্ন নগর প্রকল্প’ নিয়ে প্রথমে এক হাজার ফ্ল্যাট বিক্রি করেছি। পর্যায়ক্রমে এখানে আরও ফ্ল্যাট প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। পুরো এলাকা ঘিরে এখানে পরিকল্পিত আবাসন গড়ে তোলা হচ্ছে।
*সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
*ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৫
এইচএ/