ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৯ মাঘ ১৪৩১, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৩ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

‘আঁচল মা’য়েরা বদলে দিচ্ছেন মনোহরদীর শিশুদের

শাহজাহান মোল্লা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৫
‘আঁচল মা’য়েরা বদলে দিচ্ছেন মনোহরদীর শিশুদের ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

নরসিংদী থেকে ফিরে: শিশুর বিকাশে চাই উপযুক্ত পরিবেশ। আর সেই পরিবেশ হওয়া চাই শিশুবান্ধব।

শুধু শহর নয়, গ্রামেও উপযুক্ত পরিবেশ পেলে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব শিশুদের। এরই একটি নজির সৃষ্টি করে চলেছে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) গঠিত আঁচল কেন্দ্র। এখানে যারা কাজ করেন তাদের বলা হয় আঁচল মা।
 
নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলায় ১৩ হাজার ৩৫০ শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশে সহায়তা করছে ৫৫০ জন আঁচল মা। দিনের তিন ভাগের এক ভাগ সময় শিশুদের রাখা হয় এ আঁচল  কেন্দ্রে। প্রতিদিন সকাল ৯টা হতে দুপুর ১টা পর্যন্ত কেন্দ্রে আঁচল মায়েদের যত্নে বড় হচ্ছে শিশুরা। ধনী, গরীব প্রায় সব শ্রেণীর বাবা-মা আঁচল কেন্দ্রে নিজের শিশুকে রেখে যান। শিশুদের সুরক্ষার জন্য কেন্দ্র থেকে ১২ হাজার ২৩৩টি প্লে প্যান (চারপাশে কাঠের বেড়া দেওয়া) দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্র থেকে বাড়িতে যাওয়ার পর বাবা-মায়েরা নিজেদের ব্যস্ততার সময় শিশুদের এই প্লে প্যানে রাখতে পারবেন। এতে শিশু পানিতে পড়ে যাওয়া বা অন্য কোনো দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাবেন।  
 
শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণের পাশাপাশি পানিতে পড়ে মৃত্যু হ্রাসসহ নানান দুর্ঘটনা থেকে রক্ষার উদ্যোগ হিসেবে ২০০৫ সালে (সিআইপিআরবি) কাজ শুরু করে। এরই অংশ হিসেবে নরসিংদী জেলায় ২০১৩ সালে গঠন করা হয় আঁচল কেন্দ্র। এখানে গ্রামের আঁচল মায়েরা শিশুদের বর্ণমালাসহ আর্দশগত শিক্ষা দিয়ে থাকেন।
 
সিআইপিআরবি পাল্টে দিয়েছে নরসিংদীর মানুষের জীবনাবোধ। আঁচল কেন্দ্রে শিশুদের আদর্শবান করে গড়ে তোলার শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে এ এলাকার শিশুমৃত্যু হারও কমিয়েছে কয়েক গুণ। পাশাপাশি স্বাবলম্বী করেছে এলাকার স্বল্পশিক্ষিত নারীদের।  
 
সিআইপিআরবি’র গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৩ সালের আগে নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলায় প্রতি ১২ মাসে ১০ জন শিশু শুধু  পানিতে ডুবেই মারা যেত। আঁচল কেন্দ্র চালু হওয়ার পর এ এলাকায় এখন ২০ মাসে ৭ জন শিশু মারা যাচ্ছে বলে জানা গেছে। শিশুমৃত্যুর এ হার শূন্যতে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছে সিআইপিআরবি।
 
এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তি ও আঁচল মায়েদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাদের এ সাফল্যগাঁথা।
 
মোছা. ফেরদৌসী আরার (৩০) স্বামী মোখলেছুর রহমান চা বিক্রি করেন। অভাব অনটনের সংসারে প্রায়ই ঝগড়াবিবাদ লেগে থাকতো। এলাকায় আঁচল কেন্দ্র চালু করার কথা শুনে যোগাযোগ করেন সিআইপিআরবি’র সঙ্গে। ২০১৩ সালে আঁচল মা হিসেবে নাম লেখান ফেরদৌসী। মনোহরদী উপজেলার চন্দনবাড়ী ইউনিয়নের অর্জুনচর গ্রামে ৩৪ জন বাচ্চা নিয়ে আঁচল কেন্দ্র চালু করেন তিনি।
 
এলাকার ৯ মাস থেকে ৫৯ মাস বয়স পর্যন্ত শিশুদের নিয়ে আসা হয় আঁচল কেন্দ্রে। দিনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময় সকাল ৯টা হতে দুপুর ১টা পর্যন্ত এখানেই রাখা হয় শিশুদের।
 
সিআইপিআরবি’র গবেষণায় বলা হয়েছে, সকাল ৯টা হতে দুপুর ১টা পর্যন্ত মায়েরা রান্না ও পারিবারিক অন্যান্য কাজে বেশি ব্যস্ত থাকেন। এছাড়া এ সময়ে শিশুর ভাই, বোনও স্কুলে থাকে। ফলে এ সময়টা শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আর এ সময়টিতে শিশুদের সুরক্ষা দিতে গঠিত হয় আঁচল কেন্দ্র।      
 
ফেরদৌসী আরা বাংলানিউজকে আরও জানান, আগে আমি কিছুই করতাম না। ঘরে বসে থাকতাম, রান্নাবান্না করতাম। অভাবের সংসারে মাঝেমধ্যেই স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া হতো। আচঁল চালু করার পর আমার অভাব অনেকটাই কেটে গেছে। এখান থেকে মাসে ২ হাজার টাকা পাই, যা আমার সংসারের কাজে লাগে। তাছাড়া বাচ্চাদের সঙ্গে খুব সুন্দর সময় কেটে যায়।
 
তিনি বলেন, আমার এখন অনেক ভালো লাগে। এলাকার সবাই আঁচল মা বলে ডাকে, আমাকে সন্মান করে। পরিবারেও আমার কথার গুরুত্ব দেয়। এটা আমার জীবনে বড় পাওয়া।
 
কথা হয় আরেক আঁচল মা রিমা আক্তারের (২২) সঙ্গে। তিনি বলেন, ৫ বছর আগে বিয়ে হয়েছে। স্বামী সৌদি আরবে থাকেন। সংসারে একা একা বসে থাকতাম,  ভালো লাগতো না। আঁচল  কেন্দ্রে যোগ দেওয়ার পর সময় খুব ভালো  কাটছে। দিনের তিন ভাগের এক ভাগ সময় বাচ্চাদের সঙ্গে কেটে যাচ্ছে।  
 
এ কাজ করতে গিয়ে পরিবার থেকে কোনো বাধা আসছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথমে আমার স্বামী আমাকে বলেছিল, এসব করার দরকার নাই। এগুলো দিয়ে কি হবে। পরে যখন বললাম, আমার ভালো লাগে, সময়টা ভালোভাবে পার হয়ে যায়, তারপর থেকে আর কিছু বলে না। আমি এখন আমার টাকা দিয়ে নিজের ইচ্ছামতো খরচ করতে পারি। এটা আমার জন্য অনেক ভালো সুযোগ।
 
আঁচলের কার্যক্রমের প্রশংসা করে চন্দনবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ার‌ম্যান  মো. মোসলে উদ্দিন জানান, আঁচল কেন্দ্র চালু হওয়ার পর এ ইউনিয়নে দুর্ঘটনায় শিশুমৃত্যু অনেক হ্রাস পেয়েছে। শিশুরা ভালো শিক্ষা পাচ্ছে। আঁচলে বাচ্চা থাকা মানেই, সেই বাচ্চা নিরাপদ।
 
আঁচল কেন্দ্রে একজন শিশুকে শেখানো হয় কিভাবে বড়দের সম্মান করতে হয়। এখানে চুরি বা অন্য কোনো নেতিবাচক শব্দ সম্পর্কে ধারণা না দিয়ে বলা হয়, অন্যের জিনিস না বলে নেওয়া যাবে না। যাতে ওই শিশু চুরি শব্দটির সঙ্গে পরিচিত হতে না পারে। এমনি কাউকে বকাঝকা করা হয় না।
 
শুধু ফেরদৌসী বা রিমা আক্তার নয় এলাকার ৫৫০ জন আঁচল মায়ের সহযোগী হিসেবে রয়েছেন আরও ৫৫০ নারী। যারা এক সময় মানুষের সামনে কথা বলতে পারতেন না, তারাই আজ বিভিন্ন গঠণমূলক কাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পরিবারের পাশাপাশি সমাজেও এদের মর্যাদা বেড়েছে। নারীর ক্ষমতায়নে এরাও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৫
এসএম/আরএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।