রাজবাড়ী (চরজৌকুড়ী) থেকে: পদ্মানদীর ভাঙনে ভয়াবহ হুমকির মুখে রাজবাড়ী জেলার মিজানপুর ইউনিয়নের তিনটি স্কুল।
শিগগিরই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে যে কোনো সময় স্কুল তিনটি পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন শিক্ষকরা ও এলাকাবাসী।
বুধবার (২৩ সেপ্টেম্বর) ১ নম্বর মিজানপুর ইউনিয়নের বেনীনগর, মহাদেবপুর, চরজৌকুড়ী, রামচন্দ্রপুর, জৌকুড়া এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করে ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে এ সব তথ্য জানা যায়।
তিনটি স্কুলের মধ্যে মহাদেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে নদীর দূরত্ব মাত্র ৫ গজ (এক গজ সমান দুই হাত)। পদ্মা যেভাবে ভাঙছে, তাতে যে কোনো দিন স্কুলটি পদ্মার গর্ভে চলে যাবে।
এছাড়া চরজৌকুড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পুরোপরি পদ্মায় বিলীন হওয়ার পর এখন আছে শুধুমাত্র এর স্মৃতিচিহ্ন। পরে এলাকাবাসীর সহায়তায় নদী থেকে কিছু দূরে স্কুলটি ফের নির্মাণ করা হয়। কিন্তু ঝুঁকি রয়েই গেছে।
একই মাঠে অবস্থিত চরজৌকুড়ী উচ্চ বিদ্যালয়টিও রয়েছে একইরকম চরম ঝুঁকিতে। স্কুলটির মাঠের অর্ধেকটা ইতোমধ্যে পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। নদী থেকে স্কুলটির দূরত্ব মাত্র এখন ১৫ থেকে ২০ গজ। এ স্কুলে এলাকার প্রায় ৪০০-৫০০ ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করে। এলাকার ছাত্রছাত্রীদের কাছাকাছি স্কুল বলতে শুধুমাত্র এটিই।
স্কুলের সহকারী শিক্ষক মো. মুনছুর আলী কাজী জানান, স্কুলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সুনামের সঙ্গে স্কুলে পাঠদান করা হচ্ছে। এলাকার অনেক ছাত্রছাত্রী যারা উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পেতো না, স্কুলটি প্রতিষ্ঠার পর সেই প্রতিবন্ধকতা অনেকটাই দূর হয়ে গেছে।
![](files/raj1_566181957.jpg)
তিনি বলেন, গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সন্তানেরাই এখানে ভর্তি হয়। যাদের টাকা-পয়সা আছে, তারা শহরে চলে যায়। দরিদ্র, হতদরিদ্র পরিবারের সন্তানেরাই এখানে পড়াশুনা করে। তাদেরকেই আমরা তুলনামূলকভাবে ভালোমানের শিক্ষা দিয়ে যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
অদূর ভবিষ্যতে স্কুলটি পদ্মায় বিলীন হওয়ার আশঙ্কা থেকে তিনি বলেন, এই স্কুলটি চলে গেলে এলাকার দরিদ্র, হতদরিদ্র এবং কিছু মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা লেখাপড়া থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হবে।
তিনি বলেন, চরজৌকুড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি পদ্মায় ভাঙার আগে বিভিন্ন সময় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কর্মকর্তা দেখে গেলেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেননি। এরপর স্থানীয় নেতৃবৃন্দ স্কুলটি পরিদর্শন করে যান। কিন্তু আজ পর্যন্ত প্রয়োজনীয় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সবাই শুধু আসে, দেখে যায় আর প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু কোনো কাজ হয় না।
এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে স্কুল তিনটি রক্ষার পাশাপাশি শত শত পরিবার রক্ষার দাবিতে একাধিকবার মানববন্ধন ও জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার হয়নি বলে জানান এলাকাবাসী।
মহাদেবপুর গ্রামের আজাহার মন্ডল বলেন, গত বছরও নদী অনেক দূরে ছিল। ভাঙতে ভাঙতে এখন এত কাছে চলে এসেছে যে, যে কোনো দিন ভিটেমাটি পদ্মায় চলে যাবে। শেষ সম্বল এইটুকু ভিটেমাটি, তাও যদি চলে যায়, তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো!
চরজৌকুড়ীর গ্রামের বাসিন্দা গোলাপ মন্ডল বলেন, ছেলেমেয়ে নিয়ে নদীর পাড়েই পড়ে থাকি। রাতে ঘুম আসে না। কখন যেন পদ্মায় চলে যাবে ভিটেমাটি, এই ভয়ে থাকতে হয়! সম্পদ বলতে এই ভিটেটুকুই! এটা চলে গলে আর মাথা গোঁজার ঠাঁই থাকবে না।
![](files/raj2_137505491.jpg)
গোলাপ ও আজাহারের মতো শত শত পরিবার পদ্মার ভাঙনের আতঙ্ক নিয়ে বসবাস করছেন প্রতিটা মুহূর্ত। এক সময় এই এলাকায় সব ধরনের সবজি উৎপাদন হতো। ফলতো বিভিন্ন জাতের ধান। সবার মুখেই ছিল হাসি। আর এখন নদীর পাড়ের মানুষ শুধু দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়েন। বাকরুদ্ধ হয়ে পদ্মানদীর দিকে তাকিয়ে থাকেন। আর বলতে থাকেন- এই ভাঙনের শেষ কোথায়!
এ বিষয়ে মিজানপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আতিয়ার রহমান (আতর) বাংলানিউজকে বলেন, আমার ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম ইতোমধ্যে পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। এগুলোর মধ্যে চর নরসিংহদিয়া, বড়চর বেনীনগর, চরজাজিরা, চরছিলিমপুর, নওঘরিয়া, বড়চর রামচন্দ্রপুর, আমবাড়িয়া, কাঠুরিয়া, ছাইথুপা গ্রাম পদ্মার পেটে চলে গেছে।
তিনি বলেন, এখন ঝুঁকিতে আছে- মহাদেবপুর, বেনীনগর, চরজৌকুড়ী, রামচন্দ্রপুর, জৌকুড়া, ধাওয়াপাড়া। এখনই এসব গ্রাম রক্ষার ব্যবস্থা না করলে যে কোনো সময় এগুলোও পদ্মাগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, এতে শত শত পরিবার নিঃস্ব হবে। তাই, সরকারের কাছে দাবি, অতি শিগগির এ এলাকার নদীর পাড় বাঁধার ব্যবস্থা নেওয়া হোক। আমি ইউনিয়ন পরিষদের একজন চেয়ারম্যান হিসেবে যতটুক পারি, তা করছি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, রাজবাড়ী জেলার মিজানপুর ইউনিয়নের মহাদেবপুর, চরজৌকুড়ী, রামচন্দ্রপুর, জৌকুড়া এ এলাকার প্রায় ৬ কিলোমিটার নদী পাড়ের বাসিন্দারা চরম ঝুঁকিতে আছেন। আমি সরেজমিন দেখে এসেছি। কিছু বাড়িঘর রক্ষার ব্যবস্থা এখনই না নিলে এ বর্ষা শেষ হতে না হতেই পদ্মায় চলে যাবে।
তিনি বলেন, আমরা একটি প্রতিবেদন পানি উন্নয়ন বোর্ডকে (পাউবো) দিয়েছি। তারা চাইলে এখন কাজ শুরু করতে পারে। এ এলাকা স্থায়ীভাবে রক্ষার জন্য নদীর পাড়ে সিসি ব্লক বসিয়ে পাড় বাঁধার ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে আপৎকালীন হিসেবে যেসব বাড়িঘর ঝুঁকিতে, সেখানে জিও ব্যাগ (বস্তা) ফেলেও রক্ষা করা যায়।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৫
এসএম/এবি