ময়মনসিংহ: মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় শান্তি কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এম.এ হান্নান। এ অঞ্চলে ‘রাজাকার’ হিসেবেই তিনি সর্বাধিক পরিচিত।
কিন্তু দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির টিকিটে ময়মনসিংহ-৭ (ত্রিশাল) আসন থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে, সেই প্রত্যাশায় ভাটা পড়ে। সংসদ সদস্য হয়ে রীতিমতো বুক ফুলিয়ে চলতে শুরু করেন এম.এ হান্নান।
কিন্তু স্থানীয়দের সেই ধারণা আমূল বদলে গেলো বৃহস্পতিবার। শেষ রক্ষা আর হলো না আইয়ুব সরকারের সময় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সংসদ সদস্য দোর্দণ্ড প্রতাপশালী হান্নানের।
বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর গুলশানের নিজ বাসা থেকে গ্রেফতার হবার মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষের ৪৪ বছরের দীর্ঘ প্রতীক্ষারও অবসান হলো। তার গ্রেফতারে আনন্দে উদ্বেলিত ময়মনসিংহের মুক্তিযোদ্ধারা।
চলতি বছরের ১৯ মে মানবতা বিরোধী অপরাধে ময়মনসিংহের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ১ নং আমলি আদালতে রাজাকার হান্নানসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন ৭১’র বিধবা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুর রহমানের স্ত্রী রহিমা খাতুন।
এ মামলায় বৃহস্পতিবার হান্নান গ্রেফতার হবার পর ময়মনসিংহ শহর ও ত্রিশাল থেকে গ্রেফতার হন আরও তিন রাজাকার মিজানুর রহমান মিন্টু (৬৫), ডা. খোন্দকার গোলাম সাব্বির (৭০) ও হুরমুজ আলী (৭০)।
মহান মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের কর্মকাণ্ডে নিজেকে সপে দেয়া কুখ্যাত রাজাকার এম.এ হান্নানের গ্রেফতারের খবরটি এখন ‘টক অব দ্য ময়মনসিংহ’। চায়ের টেবিল থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা।
ময়মনসিংহ সদর উপজেলা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন মঞ্চের আহ্বায়ক ও সদর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার সেলিম সরকার রবার্ট বলেন, ময়মনসিংহ সদরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, টর্চার সেল পরিচালনাসহ অনেক কুকর্মের অগ্রভাগে ছিলেন এম.এ হান্নান।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তার অপকর্মের নানা কাহিনী সবাই জানে। এই রাজাকার গ্রেফতার হয়েছে। তার বিচার হলে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে। ময়মনসিংহ পূর্ণ কলঙ্কমুক্ত হবে।
স্থানীয়রা জানায়, দেশ স্বাধীনের পর একবার গ্রেফতার হন এম.এ হান্নান। কিন্তু পরে মুক্তি পাওয়ার পর হয়ে যান রাজধানীর গুলশানের প্রভাবশালী ব্যক্তি। এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে বাগিয়ে নেন গুরুত্বপূর্ণ প্রেসিডিয়াম সদস্য পদ।
দীর্ঘদিন ছিলেন জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক। বিভিন্ন সময়ে তাকে গ্রেফতারের দাবিতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযোদ্ধারা মিছিলও করে।
মানবতা বিরোধী অপরাধে এম.এ হান্নানের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় বাদী রহিমা খাতুন উল্লেখ করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন শহরের নতুন বাজারে অবস্থিত নিজ বাসভবন এবং জেলা পরিষদ ডাকবাংলো টর্চার সেলে মুক্তিকামী সাধারণ নিরীহ মানুষদের ধরে এনে হত্যা করে লাশ ব্রহ্মপুত্র নদের চরে ফেলে রাখতেন এম এ হান্নান ও তার সহযোগীরা।
পৈশাচিক কায়দায় বাড়ি থেকে উঠিয়ে এনে নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুর রহমানকে। পাশাপাশি এ অঞ্চলে চালান ব্যাপক গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগসহ ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ।
মামলার বিবরণীতে আরো উল্লেখ করা হয়, শহরতলী খাগডহর ইউনিয়নে মাইজবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা আতাউর রহমান আতা, শহরের কাঁচিঝুলি এলাকার শামসুদ্দিন আহমেদ টেপা মিয়ার পুত্র ধারা এবং কলেজ রোড এলাকার আব্দুল খালেকের পুত্র রমজান, ডালপট্টি এলাকার আব্দুর রশিদ, চরপাড়ার নিজাম, মুমিনুন্নিসা কলেজের পেছনের সুরুজ আলী, মাইজবাড়ির আতা, আকুয়া হাজিবাড়ীর সুরুজ, ধোপাখোলা মোড়ের অ্যাথলেট শাহেদ আলীকে আলবদর বাহিনীর দ্বারা ধরে এনে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোর টর্চার সেলে বেয়োনেট চার্জ করে ও গুলি করে হত্যা করে লাশ ব্রহ্মপুত্র নদে ফেলে দেয় রাজাকার হান্নান ও তার সহযোগীরা।
এ মামলার সাক্ষী খন্দকার আব্দুল গণির সহোদর ছোট ভাই খন্দকার আব্দুল আলী রতনকেও ১৯৭১ এর অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে রাজাকার এম.এ হান্নান তার সহযোগীদের নিয়ে তার নতুন বাজার বাসায় নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে হাত পা ভেঙে ফেলে। পরে সন্ধ্যায় জেলা পরিষদের ডাকবাংলোর নিচে নিয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
শীর্ষ রাজাকার এম.এ হান্নানের গ্রেফতার হবার খবরে তাই উদ্বেলিত ময়মনসিংহের মুক্তিযোদ্ধারা। তারা জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) অবস্থিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্পের ৯৩ বিগ্রেড কমান্ডার আব্দুল কাদিরের সঙ্গে হান্নানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
পাক বাহিনী ময়মনসিংহ অঞ্চলে যে কোনো অপারেশন পরিচালনার আগে হান্নানের সঙ্গে বৈঠক করতো। পাক বাহিনীর এই কুখ্যাত দালাল অবশেষে গ্রেফতার হয়েছে। এখন তাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হবে এ প্রত্যাশার সবার।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ০২, ২০১৫
আরআই
** ময়মনসিংহে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার ৩ আসামি গ্রেফতার
** এমপি হান্নান ও তার ছেলে ডিবি কার্যালয়ে