ঢাকা, শনিবার, ২৫ মাঘ ১৪৩১, ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

প্রথম সংবিধান ছাপার মেশিন

জাদুঘরে ‘ক্র্যাবট্রি ডাবল ডেমি টু কালার অফসেট প্রেস’

আদিত্য আরাফাত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩, ২০১৫
জাদুঘরে ‘ক্র্যাবট্রি ডাবল ডেমি টু কালার অফসেট প্রেস’ ছবি: বাংলানিউজেটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: ক্র্যাবট্রি ডাবল ডেমি টু কালার অফসেট প্রেস। আয়ুকালে অনেক কিছুই ছেপেছে মেশিনটি।

সে হিসেবে অন্য মেশিন থেকে এটি আলাদা হওয়ার কথা ছিলো না। কর্মক্ষমতা হারিয়েও বিশেষ মর্যাদায় আলাদা হয়ে গেছে মেশিনটি। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান ছেপে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে এই মুদ্রণ যন্ত্র।

কাজ থেকে সারা জীবনের ছুটি নিয়ে যন্ত্রটি এখন ইতিহাসের অংশ হতে ঠাঁই নিয়েছে জাতীয় জাদুঘরে। কালের স্মৃতি হয়ে ইতিহাসের কথা বলছে যন্ত্রটি। জড়বস্তু হলেও মানুষের কাছে মেশিনটি নিঃশব্দে প্রচার করছে বাঙালির গৌরবের কথা।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান ছাপানো মুদ্রণ যন্ত্রটির মালিক বিজি প্রেস (বাংলাদেশ সরকারি মুদ্রণালয়)। অফসেট মেশিনটি যেহেতু এখন কাজে দিচ্ছে না তাই জাতীয় জাদুঘরের কাছে এটি হস্তান্তর করেছে বিজি প্রেস।

মুদ্রণ শিল্পের ইতিহাস বলছে, ১৯০৬ সালে জন্ম হয় অফসেট মুদ্রণ পদ্ধতির। আমেরিকার নিউ জার্সির দুই হ্যারিস ভাই বাণিজ্যিকভাবে শুরু করনে এই পদ্ধতিতে অফসেট মুদ্রণ। ১৭৭৮ সাল থেকে জার্মানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ পাল্লা দিয়েছিলো এই মুদ্রণ পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য। অবশেষে সফলতা আসে ১৯০৬ সালে।

বাংলাদেশে এ পদ্ধতি প্রথম ব্যবহার হয় ভাষা আন্দোলনের বছরে। ১৯৫২ তে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের জন্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স ইন্দো সুইস ট্রেডিং কোস্পানি লিমিটেড এটিকে ঢাকায় এনেছিলো ৭৪ হাজার ৮৪০ টাকা ৪৩ পয়সা ব্যয়ে। কাজ শুরু করে হয় একই বছরের এপ্রিলে। ১৫ টন ওজন আর সাত ফুট উচ্চতার যন্ত্রটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ছিল ইংল্যান্ডের মেসার্স আর-হু অ্যান্ড ক্র্যাবট্রি লিমিটেড। এটি কার্যক্ষমতা হারায় ১৯৮৬ সালে।

১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর দেশ হানাদারমুক্ত হওয়ার পর সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রটির প্রয়োজন হয় একটি সংবিধানের। ১৯৭২ সালে প্রণীত হয় প্রথম সংবিধান। প্রয়াত একেএম আব্দুর রউফ প্রথমে এটা হাতে লেখেন। প্রশ্ন ওঠে কোথায় এর মুদ্রণ হবে। সিদ্ধান্ত হয় ভাগ্যবান প্রতিষ্ঠানটি হবে বর্তমান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীন মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন বিজি প্রেস।

১৯৭২  সালে বিজি প্রেসের অফসেট শাখার প্রধান ছিলেন মরহুম মীর আজাহার আলী। তার নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের সংবিধান ছাপানোর কাজ সমাধান করেন তৎকালীন অফসেট অপারটের মো. আবু সাঈদ ও মো. নুরু মিয়া এবং সেই শাখায় কর্মরত আব্দুল মজিদ খান।

মুদ্রণের এই কারিগরদের মধ্যে এখন কেবল বেঁচে আছেন আবু সাঈদ। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, দুই থেকে তিন সপ্তাহ ধরে ছাপা হয় ৫০০ কপি সংবিধান। খরচ পড়েছিলো ১৪ হাজার টাকা।

তিনি আরো জানান, প্রথম ছাপানো ১২০ পৃষ্ঠার সংবিধানের আকার ছিল ১৮ ইঞ্চি বাই ২৩ ইঞ্চি।  

বহু সংগ্রামের পর পাওয়া সংবিধান ছাপানোর ক্ষেত্রে এর সৌন্দর্যের দিকটি বিশেষ প্রাধান্য পায়। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন এই গুরু দায়িত্ব প্রদান করেন কিংবদন্তি শিল্পী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে। শিল্পাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত টিমের অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন বরেণ্য শিল্পী হাশেম খান, জুনাববুল ইসলাম, আবুল বারক্ আলভী ও সমরজিৎ রায় চৌধুরী।

জানা গেছে, সংবিধান নান্দনিক করতে আন্তরিক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কাজটি শৈল্পিক করতে তিনি আস্থা রেখেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ওপর। তিনি (শিল্পচার্য) হাশেম খানকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে যান। স্বাধীনতার মহানায়ক তাদের আন্তরিকভাবে কাজটি করতে বলেন। সে অনুযায়ী সংবিধানে নান্দনিক রূপ দেন শিল্পচার্য।

জানা যায়, ছাপার উন্নতমান নিশ্চিত করতে প্রথমে বেসরকারি মালিকানাধীন পাইওনিয়ার প্রেস কিংবা পদ্মা প্রেসে সংবিধান ছাপানোর কথা চিন্তা করা হয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে ছাপিয়ে আনার বিষয়টিও ছিল আলোচনায়। সে সময় সরকারি মালিকানাধীন বিজি প্রেসের সামর্থ্য ছিল সীমিত। কিন্তু খরচ কমাতে শেষ পর্যন্ত বিজি প্রেসে ছাপা সম্ভব কিনা তা খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখন সদ্য স্বাধীন দেশ। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে চলছে দেশ গড়ার কাজ। অন্যদের মতো দেশাত্মবোধের চেতনায় উজ্জীবিত বিজি প্রেসের কর্মকর্তা কর্মচারীরাও। তারা যতো সীমাবদ্ধতাই থাকুক না কেন, আন্তরিকভাবে কাজ করে ভালো ছাপা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেন। ওই সময় বিজি প্রেসে থাকা সবচেয়ে আধুনিক মেশিন ক্র্যাবট্রি ডাবল ডিমাই টু কালার অফসেট প্রেস ছাপার জন্য বেছে নেওয়া হয়। মূলত এই মেশিনটিতেই ছাপা হয় হাতে লেখা প্রথম সংবিধান।

জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী বলেন, হাতে লেখা সংবিধানের মূল কপি জাতীয় জাদুঘরে রয়েছে। বিজি প্রেসে ছাপা হওয়া সংবিধানের একটি কপি গ্যালারিতে প্রদর্শিত হচ্ছে। এখন সংবিধান প্রথম ছাপার মেশিনও যাদুঘরের কাছে হস্তান্তর করেছে বিজি প্রেস। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের। ইতিহাসের কথা বলবে মেশিনটি।

গত বছরের ১৯ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে মুদ্রণযন্ত্রটি বিজি প্রেস থেকে জাতীয় জাদুঘরের হস্তান্তরের প্রস্তাব পাস হয়। প্রস্তাব অনুমোদন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর শুরু হয় হস্তান্তর প্রক্রিয়া। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রথমে অসংখ্য মেশিনের মধ্য থেকে সংবিধান ছাপার কাজে ব্যবহৃত মেশিনটি চিহ্নিত করা হয়। পরে সেটি বাইরে বের করে চলে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ।

হস্তান্তরের আগে বিজি প্রেসে গিয়ে দেখা যায়, পরিত্যক্ত অন্য মুদ্রণযন্ত্রগুলো থেকে ক্র্যাবট্রি ডাবল ডিমাই অফসেট প্রেস আলাদা করে ভবনের পেছনের খোলা জায়গায় রাখা হয়েছে। বেশ বড়সরো কাঠামো। পুরোটাই লোহার। তবে ময়লা আর মরিচা ধরা। সেগুলো দূর করতে কাজ করছে বিজি প্রেসের বেশ কয়েকজন কর্মী। মরিচা ধরা লোহা লক্কর ধীরে ধীরে আপন চেহারা ফিরে পায়। চলতি বছরের ১৭ আগস্ট জাতীয় জাদুঘর পায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান ছাপানো এই মুদ্রণযন্ত্রটি।

বাংলাদেশ সময়: ০০৩৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৩, ২০১৫
এডিএ/এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।