তালা (সাতক্ষীরা): কপোতাক্ষ নদের তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি ঠিকমতো নিষ্কাশিত হচ্ছে না। এতে নদের তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে তৈরি হয়েছে স্থায়ী জলাবদ্ধতা।
বন্যার পানি এখনো নেমে না যাওয়ায় সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন তালা উপজেলার কয়েক হাজার পরিবারের মানুষ।
কপোতাক্ষের এ জলাবদ্ধতার কারণে দিনদিন মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। ফলে অনেকের কৃষি জমিতে ভালো ফসল হলেও ঘরে তুলতে পারেননি তারা।
এদিকে, নদের আশপাশের গ্রামগুলোর অধিকাংশ বাড়িঘর পানিবন্দি থাকায় অনেকেই বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ কেউ রাস্তার পাশে খুপড়ি ঘর তৈরি করে কোনরকমে দিনানিপাত করছেন।
এলাকার সব পিচঢালা সড়ক ডুবে গেছে পানির নিচে। ফলে যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থাতেও দেখা দিয়েছে চরম দুর্ভোগ।
স্থানীয়দের অভিযোগ, কপোতাক্ষ নদ খননে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে তা কোনো কাজে আসেনি। ফলে জলাবদ্ধতার হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছে না এ অঞ্চলের প্রায় দেড় হাজারেও বেশি পরিবার।
কপোতাক্ষ তীরে জলাবদ্ধতাকবলিত তালা উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নের প্রায় ১ হাজার ৫০০ পরিবারের অন্তত ৮ হাজার মানুষ গত ৩ মাস ধরে পানিবন্দি অবস্থায় বসবাস করছেন। এ অবস্থা থাকবে প্রায় আরো ৩ মাস।
পানিতে তাদের ফসলি জমি, বাড়িঘর, পুকুরসহ সব ডুবে রয়েছে। এতে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন বহু মানুষ। কাজ না থাকায় ঠিকমতো ২ বেলা খাবারের ব্যবস্থা করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে বেশিরভাগ মানুষকে।
উপজেলা পরিষদ থেকে পরিবারপ্রতি ৫ কেজি করে চাল দেওয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। তবে পানিবন্দি মানুষের দাবি, তারা ত্রাণ চান না। পানি অপসারণ করে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো হোক।
শনিবার (৩ অক্টোবর) সরেজমিনে উপজেলার কানাইদিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, জলাবদ্ধ এলাকার অধিকাংশ সড়ক পানিতে ডুবে আছে। একবাড়ি থেকে অন্য বাড়ি যেতে নৌকা অথবা সাঁকোই ভরসা। বাড়িঘর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, ডোবা-নালা, ফসলি জমি সবই পানিতে তলিয়ে আছে। পানি না নেমে যাওয়ায় দুর্ভোগ কমছে না।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়া, সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন সমস্যা। এতে নারী ও শিশুদের দুর্ভোগ সবচেয়ে বেশি।
ভর দুপুরে কানাইদিয়া গ্রামের বলাইর মোড়ে ডুবে থাকা পিচঢালা রাস্তার ওপর দাঁড় করানো কয়েকটি নৌকা। এ নৌকায় করে এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি, এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে যোগাযোগ রক্ষা হচ্ছে। এমনকি বিদ্যালয়ে যাতায়াতের জন্যও নৌকাই ভরসা শিক্ষার্থীদের। তবে সবার নৌকা কেনা বা তৈরির সামর্থ্য না থাকায় পরিবারের শিশুরা কোমর কিংবা গলা পানি পেরিয়ে যাচ্ছে স্কুলে।
স্থানীয়রা জানান, কপোতাক্ষ নদের তলদেশ এখন আশপাশের কৃষিজমি থেকে ১২/৩ ফুট উঁচু হয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে সবগুলো স্লুইসগেট। ফলে নদে জমে থাকা পানি সরছে না। এর সঙ্গে একটু বৃষ্টি হলেই পানি উপচে ভাসিয়ে দিচ্ছে বাড়িঘর ও ফসলি মাঠসহ সবকিছু। গত ৭ বছর ধরেই নিয়মিত এ রকম দুর্ভোগ সহ্য করতে হচ্ছে এখানকার বাসিন্দাদের।
কানাইদিয়া গ্রামের বাসিন্দা আবদুল জলিল গাজী জানান, পর পর ৭ বছর ধরে জলাবদ্ধতায় তার সব গেছে। গাছ মরে যাচ্ছে। ফসল নষ্ট হয়েছে। তারা ত্রাণ চান না, পানি সরানোর ব্যবস্থা চান। পানি নেমে গেলেই তারা বাঁচেন।
কানাইদিয়া গ্রামের রাস্তায় খুপড়ি ঘরে আশ্রয় নেওয়া আব্দুল্ল্যা কারিগর জানান, তিনি বাড়ি ঘর ছেড়ে ২ মাস আগে রাস্তায় এসে আশ্রয় নিয়েছেন। পাটকাঠির বেড়া ও পলিথিন দিয়ে খুপড়ি ঘর করে আছেন। তার মতো প্রায় ২ শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে এ রাস্তার উপর। তবে তারা কবে নিজের বাড়িতে ফিরতে পারেন তা জানেন না।
চরকানাইদিয়া গ্রামের আকলি বেগম জানান, তার বাড়ির চারপাশে পানি। তলিয়ে গেছে টিউবওয়েল। বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকটে রয়েছেন তারা। গত ৩ মাসে ৫ কেজি চাল পেয়েছেন। আর কেউ কিছু দেয়নি।
এসব এলাকার মানুষের দাবি, সুষ্ঠুভাবে কপোতাক্ষ খনন করা হোক। কপোতাক্ষ খনন না হলে এলাকার মানুষকে বাঁচানো যাবে না।
এ বিষয়ে স্থানীয় জালালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম মফিদুল হক লিটু বাংলানিউজকে বলেন, ইউনিয়নের দেড় হাজার পরিবার জলাবদ্ধতার শিকার। প্রায় ৩ মাস ধরে এ অবস্থায় বসবাস করছেন তারা। ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় ত্রাণ হিসাবে সামান্য পরিমাণ চাউল দেওয়া হয়েছে। তবে সমস্যা সমাধানে নদী খনন ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই।
জানতে চাইলে তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, তারা এ জলাবদ্ধতা দূর করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কি উপায়ে পানি অপসারণ করা হবে তা এখনো ঠিক হয়নি।
যোগাযোগ করা হলে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কেশবপুরের এসডি শফিকুল ইসলাম বলেন, তারা পানি নিষ্কাশনের চেষ্টা করছেন।
বাংলাদেশ সময়: ০০৪০ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৬, ২০১৫
এসআর