ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৩ মাঘ ১৪৩১, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৬ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

মীনা’র জন্য ভালোবাসা

সাজেদা সুইটি, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০১৫
মীনা’র জন্য ভালোবাসা ছবি : জি এম মুজিবর/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: দিনটি যেন মীনা’কে প্রাণভরে ভালোবাসার। হবেই না কেন? মীনা যে প্রতিবাদী এক শিশু, যে বঞ্চিত হতে নয়, সমাজের বোঝা হতে নয়, চায় সবার সঙ্গে শক্তি নিয়ে এগোতে।


 
তাইতো মীনা, রাজু ও মিঠুকে পেয়ে শিশুদের উচ্ছ্বাস যেন আর কমতে চায় না। জড়িয়ে ধরে চুমু, সেলফি, উচ্চস্বরে হেসে ওঠা- এভাবেই ভালোবাসা উজাড় করে দেওয়ার চেষ্টা।
 
শনিবার (১০ অক্টোবর) রাজধানীর আগারগাঁও এলজিইডি মিলনায়তনে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শিশুরা নাচে, গানে, অভিনয়ে পালন করলো মীনা দিবস। দিবসটি মূলত ২৪ সেপ্টেম্বর হলেও অনিবার্য কারণে কিছুদিন পিছিয়ে পালিত হল। তাতে অবশ্য শিশুদের আনন্দ কমেনি।
 
সকাল আটটা থেকে মিলনায়তনে গরমে সেদ্ধ হচ্ছিল শিশুরা। কিন্তু কোনো বিরক্তি নেই, মুখে হাসি।
 
প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান, ইউনিসেফ প্রতিনিধি এডোয়ার্ড বেগবিদার, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আলমগীর বক্তব্য দিলেন। মীনা এ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে কতোটা ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে, সেসব বললেন তারা।
 
তারা বললেন, শিশুদের কাছে স্কুলকে উপভোগ্য করেছে মীনা। ভাই-বোনের মর্যাদা ও গুরুত্ব যে সমান তা বুঝিয়েছে মীনা। মীনা শিখিয়েছে, বাল্যবিবাহ ঠিক নয়। ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, বৈষম্য বিলোপে মীনার অবদান অনেক।
 
সমাজের বিদ্যমান অনিয়মে বরাবরই প্রতিবাদী ১০ বছরের মীনা। কেন, কেন নয়- এ প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজে সমাধানের রাস্তা দেখাচ্ছে সে ২৫ বছর ধরে। তার সঙ্গে রয়েছে ছোট ভাই রাজু, বন্ধু পাখি মিঠুও।
 
এতো গেল বড়দের ভারিক্কি কথা। এরপর এল ছোট্ট সব শিশুদের পালা, যা দেখে মুগ্ধ হতে হল সব বড়কে।
 
কেরাণীগঞ্জের চুনকুটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র অন্তর মল্লিক। দল নিয়ে জারিগানে সবাইকে মীনা’র সমর্থনে কাজ করতে আহবান জানালো।
 
বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপে অন্তর জানায়, তার বাবা অন্যের দোকানে কাজ করেন। সে বড় হয়ে বাবার সম্মান আরও বাড়াবে। ছেলের গান, পড়ালেখায় উৎসাহ দেন তিনি। ছেলে তার গর্ব।
 
অটিস্টিক শিশুরা যদি স্কুলের বন্ধুদের সহযোগিতা পায়, তাহলে ভালো থাকতে পারে- এমন শিক্ষা নিয়ে শুরু হল নাটক।
 
মতিঝিল আইডিয়াল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এতে অভিনয় করে। এতে দেখা যায়, মীনা রাজু ও মিঠুকে নিয়ে স্কুলে যায়। সেখানে শিক্ষিকা তাদের নতুন বন্ধুকে আলাপ করিয়ে দেন। তিনি বলেন, নতুন বন্ধুটি অটিস্টিক। অটিজম মস্তিস্কে বিকাশজনিত সমস্যা।
 
তাকে বন্ধু করে নিতে ছোটভাইকে উৎসাহ দেয় মীনা।
 
শিক্ষিকার ভূমিকায় অভিনয় করে তাসনিয়া রহমান তাসনিম।
 
বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপে সে জানায়, বাবা ব্যাংকার, মা বিসিআইসি’তে কর্মরত। মানিকনগরে তাদের বাসা। বড় হয়ে তাসনিম এমন শিক্ষিকাই হতে চায়। যাতে আরও অনেক মীনাকে পড়াতে পারে। অটিস্টিক শিশুদের স্বাভাবিক আদরে স্বাভাবিক জীবনের দিকে আনার চেষ্টা করতে পারে।
 
এরপর গম্ভীরা পরিবেশন করে আসর জমিয়ে দেয় ধামরাই উপজেলার নানা-নাতি।
 
বাংলাদেশসহ বিশ্বের কোথাও যেন শিশুশ্রম না থাকে, সে চেষ্টা চালাতে গানে গানে আহবান জানায় তারা।
 
‘নানা’ তাওরাত মাহমুদ তাজ ধামরাইয়ের পাঠানতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। তার প্রবাসী বাবা ও গৃহিণী মা ছেলেকে নিয়ে অনেক গর্ব করেন বলে বাংলানিউজকে জানায় তাজ।
 
‘নাতি’ আকাশ ভৌমিকও একই স্কুলের ছাত্র। সে সব সময় শিশুদের অধিকার রক্ষায় কাজ করবে বলে বাংলানিউজকে জানায়।
 
দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘কন্যাশিশু বিয়ে দিয়ে করো নাকো ভুল, প্রত্যেকটি শিশু যেন এক একটি ফুল’। প্রতিপাদ্য অনুসারে বড় পর্দায় দেখানো হল মীনা কার্টুনের ‘বিয়ের বয়স হয় নাই’ পর্বটি।
 
এরপর পাপেট শো। তৃতীয় শ্রেণির মেধাবী ছাত্রীর বাবা কিছুটা দরিদ্র। ঘটক এ  সুযোগটাই কাজে লাগান। এক বয়স্ক ধনীর সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব এনে বাবাকে রাজিও করিয়ে ফেলেন।
 
কিন্তু স্কুলের শিক্ষক তাদের জানিয়ে দেন, ‘বাল্যবিবাহ আইনত দণ্ডনীয়’। বন্ধ হল শিশুবিয়ে।
 
মঞ্চে আসে বিশালাকৃতির মীনা, রাজু, মিঠু। তাদের সঙ্গে ছবি তোলার সুযোগ পায় শিশুরা। ঢাকা উদ্যানের কাছেই ‘ঝিনুক মালা’ নামে একটি সংগঠনের সদস্য আনোয়ার হোসেন ‘মীনা’ চরিত্রে, হাসান ‘রাজু’ চরিত্রে এবং ‘মিঠু’ চরিত্রে অভিনয় করে রুপা ইসলাম।
 
জোর করতালিতে মিলনায়তন কিছুক্ষণ পরপরই সরগরম। মুগ্ধ মন্ত্রী ও অতিথিরা। মঞ্চে এসে পুরস্কার তুলে দেন সবার হাতে।
 
শিশুরা মঞ্চ থেকে শিক্ষকের কাছে জানতে চায়, ‘কেমন হইছে, আপা?’
 
শিক্ষক সস্নেহে বুকে জড়িয়ে বলেন, ‘খুব ভালোরে’!
 
১৯৯১ সালে ১০ বছর বয়সী বালিকা হিসেবে মীনা চরিত্রের সৃষ্টি। সমাজের কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, বিভেদ, বৈষম্য দূর করতে এটি বিভিন্ন বার্তা উপস্থাপন করে আসছে। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল তথা দক্ষিণ এশিয়ার মেয়েশিশুদের প্রতিনিধিত্ব করছে এ চরিত্রটি।
 
মীনা কার্টুন পর্ব ও মীনা বই সব বয়সীদের মাঝে সাড়া ফেলেছে।
 
১৯৯৮ সাল থেকে দেশব্যাপী দিবসটি পালন করে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা। প্রতিবারের মতো জেলা-উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ৠালি, মীনা বিষয়ক রচনা প্রতিযোগিতা, চিত্রাঙ্কন, যেমন খুশি তেমন সাজো কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে এবারও।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০১৫
এসকেএস/এএসআর

** সমাজের অনিয়ম রোধেও মীনা’র প্রয়োজন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।