খুলনা (মামুদকাটী) থেকে ফিরে: অজো পাড়াগ্রাম, সন্ধ্যা নামলেই চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। পল্লী বিদ্যুতায়নের কারণে কোন বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছুলেও কাটেনি অন্ধকার।
খুলনা জেলার মামুদকাটী গ্রামের কথা এগুলো। শুক্রবার (০৯ অক্টোবর) প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই অনির্বাণ লাইব্রেরির ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বী মিয়ার যাওয়ার কথা ছিলো। পরে গুরুতর অসুস্থ হওয়ায় ডেপুটি স্পিকার তার সফর বাতিল করলেও উপস্থিত হন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের কর্মকর্তারা।
ডেপুটি স্পিকার না গেলেও, লাইব্রেরির চলার পথের সাথী হতে ও লাইব্রেরি আন্দোলনের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে ১ লাখ টাকার অনুদান দাতা সদস্য হন তিনি। একই সাথে ঢাকায় ডেপুটি স্পিকারের বাসভবন থেকে টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে লাইব্রেরি আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্তার কথা জানান তিনি।
অনির্বান লাইব্রেরির ইতিহাস ঐতিহ্য তুলে ধরেন লাইব্রেরির সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সমীরণ দে। শুক্রবার (০৯ অক্টোবর) অনির্বাণ লাইব্রেরির রজত জয়ন্তী অনুষ্ঠান শেষে বাংলানিউজের সাথে আলাপকালে সভাপতি বলেন, দেশে তখন প্রবল গণআন্দোলন। সামরিক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে লড়ছে গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী দেশের সকল নাগরিক। আর এমনি একটি সময়ে জেলা সদর থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে প্রত্যন্ত গ্রামের কয়েকজন যুবক ভাবছিলো গ্রামের মানুষের জন্য কিছু করার কথা। মামুদ কাটী গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কবি মাইকেল মধুসুদন দত্তের প্রিয় কপোতাক্ষ নদের পাড়ে একদিন সন্ধ্যায় আড্ডা দিতে দিতে স্থানীয় সোনাতন কাটী গ্রামের জয়দেব ভদ্র (বর্তমানে এসপি-হবিগঞ্জ) ও মানিক ভদ্র, মামুদ কাটী গ্রামের বিশ্বকর্মা মন্ডল ভোলা এবং হরিঢালী গ্রামের মৃণাল ঘোষ সিদ্ধান্তে পৌঁছালো গ্রামে একটি লাইব্রেরি স্থাপনের।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজও এগুলো। আশপাশের কয়েক গ্রামের আগ্রহীদের নিয়ে বৈঠক করে লাইব্রেরি স্থাপনের কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। এক্ষেত্রে স্থানীয় স্কুল কলেজের শিক্ষকদের পাশাপাশি ছাত্র-ছাত্রীদের এই কর্মকাণ্ডে যুক্ত করা হলো। এরপর ১৯৯০ সালের ১০ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে লাইব্রেরিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। মহান বিজয়ের মাসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলার অঙ্গীকার নিয়ে ‘অনির্বাণ লাইব্রেরি’র যাত্রা শুরু হলো।
খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার মামুদ কাটী গ্রামের কেন্দ্রস্থলে থাকা হরিসভার একটি ঘরে এই লাইব্রেরির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথমে প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের বাড়িতে যে সকল বই ছিলো সেগুলো দিয়ে লাইব্রেরির কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর সকলের কাছ থেকে বই ও অর্থ সংগ্রহ করা হয়।
প্রত্যন্ত উপকূলের একটি গ্রামে লাইব্রেরির কার্যক্রম শুরু হলেও কয়েক বছরের মধ্যেও তা খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় মানুষকে আকৃষ্ট করে। দুর-দূরান্তের অনেকেই এই লাইব্রেরির কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হন। কালক্রমে প্রতিষ্ঠানটি হয়ে ওঠে ওই অঞ্চলে প্রগতিশীল সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম কেন্দ্রস্থল। ছাত্র-ছাত্রীদের বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে গড়ে তোলার পাশাপাশি লাইব্রেরির পক্ষ থেকে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়। সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশিত হয়। বিনামূল্যে মেডিকেল ক্যাম্প পরিচালনাসহ নানা ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানেও রয়েছে লাইব্রেরির সম্পৃক্ততা। লাইব্রেরির পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া হয়ে । ইতোমধ্যেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি কেন্দ্র চালু ও এলাকার শিক্ষার্থীদের আইটি প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
লাইব্রেরিতে গল্প, উপন্যাস, নাটকসহ প্রায় এক হাজারের বেশি বই রয়েছে। লাইব্রেরির সদস্যরা বই বাড়িতে নিয়ে পড়তে পারেন। তবে লাইব্রেরিতে বসে যে কেউ বই ও পত্রিকা পড়তে পারেন। এখানে জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা রাখা হয়। লাইব্রেরিটি ইতোমধ্যে সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধিত হয়েছে। কিন্তু সরকারি সহায়তা খুবই কম পেয়েছে। লাইব্রেরির সদস্য ও শুভাকাঙ্খীদের সহায়তায় নিজস্ব ভবন তৈরির জন্য ১১ শতাংশ জমি কেনা সম্ভব হয়েছে। যেখানে তিন তলা ভবন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আধুনিক এই ভবন নির্মাণে আনুমানিক ৬০ লাখ টাকা বাজেট ধরা হয়েছে। চলতি বছরে মন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এই খাতে এক লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এই খাতে সহায়তার জন্য সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সর্বস্তরের মানুষের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
লাইব্রেরিতে আজীবন সদস্য, দাতা সদস্য ও সাধারণ সদস্য এই তিন ধরনের সদস্য রয়েছে। লাইব্রেরির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী যে কেউ এক হাজার টাকা দিয়ে ফরম পুরণ করে সদস্য হতে পারেন। আর আজীবন সদস্য হতে ২০ হাজার টাকা এককালীন চাঁদা দিতে হবে। আর এর বেশি মূল্যের বই বা প্রয়োজনীয় উপকরণ অথবা আর্থিক অনুদান দেবেন তারা দাতা সদস্য হিসেবে তালিকাভুক্ত হবেন। সারা বছরই লাইব্রেরির সদস্য সংগ্রহ অভিযান চলে। বর্তমানে সদস্য ৩১৭ জন।
লাইব্রেরির কর্মকাণ্ড: লাইব্রেরিতে সারা বছরই কোন না কোন কর্মসূচি থাকে। মহান স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসসহ বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালন করা হয়। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্যসহ বিভিন্ন কবি সাহিত্যিকদের জন্ম-জয়ন্তী পালন করা হয়। বাংলা নববর্ষসহ বিভিন্ন উৎসব আয়োজন করা হয়। এসব অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচি এলাকার সাধারণ মানুষের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয়। এলাকার শিল্পীরাই নাটক থেকে শুরু করে সকল পরিবেশনায় অংশ নেন। পাশাপাশি জেলা শহর ও রাজধানী থেকেও শিল্পীরা ওই কর্মসূচিতে অংশ নেন।
লাইব্রেরিতে প্রতিবছরই ছাত্র-ছাত্রীদের বইপড়া, কবিতা, গানসহ সংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা প্রতিযোগিতাও থাকে। এসব প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পাশাপাশি মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে পুরুস্কার বিতরণ করা হয়। বই পড়ার পাশাপাশি লাইব্রেরিতে কবিতা পাঠ, গান শেখানো, এমনকি একাডেমিক পড়ায় সহায়তা করা হয়। লাইব্রেরির সিনিয়র সদস্যরা এক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাইভেট পড়ানোর কাজটি করেন। এখান থেকে কৃষি বিষয়ক নানা তথ্যও দেওয়া হয়। চাইলে চাকরির খোঁজ-খবর নিতে পারেন। ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি বাইরে কথা বলারও সুযোগ রয়েছে লাইব্রেরিতে।
লাইব্রেরির উদ্যোগে বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা কর্মসূচি এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। এলাকার ছেলে-মেয়ে যারা এখন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে দায়িত্ব পালন করছেন তারাই এই মেডিকেল ক্যাম্পে চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। এছাড়াও আগ্রহী অনেকেই এসেছেন লাইব্রেরির এই উদ্যোগের সঙ্গে সংহতি জানাতে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন দুর্যোগের সময় লাইব্রেরির সদস্যরা স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে ত্রাণ সংগ্রহ ও বিতরণে অংশ নেন তারা। লাইব্রেরির উদ্যোগে প্রতি বছর বৃক্ষ রোপন কর্মসূচির পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষাসহ সামাজিক বিভিন্ন ইস্যুতে গণসচেতনতামূলক কর্মসূচি পালিত হয়।
শুরু থেকে লাইব্রেরির বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালনকারীদের অধিকাংশই রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে চাকরিসহ নানা পেশায় নিয়োজিত। তারাই লাইব্রেরির প্রধান পৃষ্ঠপোষক। বর্তমানে লাইব্রেরির সভাপতির দায়িত্বে আছেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সমীরণ দে। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন প্রভাত দেবনাথ।
লাইব্রেরির প্রথম কমিটির সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক কালিদাশ চন্দ্র চন্দ ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মানিক ভদ্র। এলাকার প্রবীন শিক্ষক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ রয়েছে। যে উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি আছেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক যামিনী সরকার। আর লাইব্রেরির বই লেনদেন, চাঁদা আদায় ও সদস্য সংগ্রহের জন্য সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেন উত্তম বসু বাবু। লাইব্রেরির সদস্যরা মাসিক ১০ টাকা থেকে ১০০ টাকা চাঁদা দিয়ে থাকেন।
সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সহায়তায় ও এলাকার শিক্ষিত যুবকের পরিশ্রমে হাঁটি হাঁটি পা পা করে লাইব্রেরি ২৫ বছর পার করলো। এই লাইব্রেরির রয়েছে অনেক ইতিহাস। বিশেষ করে সামাজিক আন্দোলনে অন্ধকারে আলোর পথ দেখায় লাইব্রেরিটি। এই লাইব্রেরি এখন মামুদকাটী গ্রামের আলোর দিশারী।
অনির্বাণ লাইব্রেরির রজত জয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন সাতক্ষীরা-১ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মুস্তফা লুৎফুল্লাহ, যশোর-৫ আসনের সংসদ সদস্য স্বপন ভট্টাচার্য্য, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী তিমির নন্দী, লেখক-সাহিত্যিক অধ্যক্ষ তৌহিদুর রহমান, হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) জয়দেব কুমার ভদ্রসহ স্থানীয় গুণিজন।
বাংলাদেশ সময়: ১১২২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০১৫
এসএম/জেডএম