ঢাকা, মঙ্গলবার, ২১ মাঘ ১৪৩১, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৪ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

মূল নকশা পেনসিলভেনিয়ায়, টাকা দিয়ে আনবে বাংলাদেশ

শাহজাহান মোল্লা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০১৫
মূল নকশা পেনসিলভেনিয়ায়, টাকা দিয়ে আনবে বাংলাদেশ

ঢাকা: জাতীয় সংসদ ভবনসহ আগারগাঁও এলাকার স্থাপত্যের মূল নকশা আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সংসদ সচিবালয়। প্রখ্যাত স্থপতি লুই আই কানের ওই নকশা এখন সংরক্ষিত আছে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া ইউনির্ভাসিটির আর্কিটেকচারাল আর্কাইভে।



২০ হাজার নকশার ভেতর থেকে বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক নকশা বেছে দিতে ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে ৩ হাজার ৫৫০ ইউএস ডলার (১ ডলারে ৭৮ টাকা)। আর মূল নকশা আনতে  আরো ৪ লাখ ইউএস ডলার দিতে হবে বাংলাদেশকে।

লুই আই কান এর মূল নকশা হাতে না থাকায় সংসদ ভবনসহ আগারগাঁও এলাকায় স্থাপনা নির্মাণে ব্যত্যয় ঘটছিল এতোদিন।
 
বিষয়টি অনুধাবন করে সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি লুই আই কান এর মূল নকশা সংগ্রহের নির্দেশ দেন সংসদ সচিবালয়কে। সর্বশেষ গত ১৩ অক্টোবর একনেক বৈঠকেও প্রধানমন্ত্রী লুই আই কান এর মূল নকশা আনার তাগাদা দেন। কেননা মূল নকশা হাতে না থাকায় আগারগাঁওয়ে সচিবালয় স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করা যাচ্ছে না।

সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৪ সালে লুই আই কান যখন মূল নকশাটি করেন, তখন ২৭টি মন্ত্রণালয়ের জন্য এ পরিকল্পনা করা হয়। সেই নকশায় ছিলো মসজিদ, মাঝে বাগান, চন্দ্রিমা উদ্যানের ওখানে একটি বড় সড়ক ছিল, এর সামনে লেক ছিল, এরপর সংসদ ভবন ছিল। তাই অনুলিপি নয়, ১৯৭৪ সালের মূল নকশা ধরে সব কিছু করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

১৯৭৪ সালে শেরেবাংলানগরে ৪২ একর জায়গায় জাতীয় সচিবালয় নির্মাণের জন্য সরকার ও মার্কিন কোম্পানি ডেভিড উইসডম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের সঙ্গে চুক্তি হয়। পরে এর কোনো অগ্রগতি হয়নি। ওই এলাকায় এরই মধ্যে ১০ একর জমিতে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। জমি কমে যাওয়া এবং বর্তমানের চাহিদা বিবেচনায় লুই আই কানের নকশা কিছুটা সংশোধন করেছে স্থাপত্য অধিদপ্তর।

নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে সংসদ ভবন এলাকার ভেতরেই গড়ে তোলা হয়েছে মাজার ও কবরস্থান। এর মধ্যে সংসদ ভবনের উত্তরে ৭৪ একর জায়গা জুড়ে নির্মিত চন্দ্রিমা উদ্যানের মধ্যিখানে  বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে তোলা হয় জিয়ার মাজার কমপ্লেক্স। আর জিয়া ও এরশাদের শাসনামল মিলিয়ে সংসদ ভবনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে মানিক মিয়া এভিনিউ এর পশ্চিম প্রান্ত লাগোয়া স্থানে পাঁচ বিঘারও বেশি জায়গাজুড়ে ‘জাতীয় কবরস্থান’ নাম দিয়ে আরো অন্তত সাতজনকে সমাধিস্থ করা হয়েছে।

এদের মধ্যে ১৯৭৯ সালে সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ ও রাজনীতিক মসিউর রহমান যাদু মিয়া, ১৯৮০ সালে তমীজ উদ্দিন খান, ১৯৮২ সালে খান এ সবুর, এবং ১৯৯১ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খানকে কবর দেওয়া হয়। প্রত্যেকের কবরে তোলা হয় পাকা সমাধিসৌধ।

সংশ্লিষ্টরা জানান, লুই আই কানের প্রাথমিক নকশা অনুযায়ী, ২০৮ একর জায়গার ওপর জাতীয় সংসদ ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা ছিলো। যার সামনে ও পেছনে বিস্তীর্ণ সবুজ খোলা মাঠ থাকবে। চারদিকে আট লেনের সড়ক, মাঝখানেও লেক থাকবে। লেকের পর থাকবে বিস্তীর্ণ সবুজ অঙ্গন। অবশিষ্ট জায়গায় গড়ে তোলা হবে সচিবালয়, লাইব্রেরি, জাদুঘর, হাসপাতালসহ প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক বলয়।

কিন্তু ল‍ুই আই কানের মুল নকশা ক্ষত-বিক্ষত করার প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। জোট সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী মির্জা আব্বাস তার ছোট ভাই মির্জা খোকনকে আসাদগেটের উল্টো দিকে সংসদ ভবনের জায়গা বরাদ্দ দেন পেট্রোলপাম্প স্থাপনের জন্য।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মাঝামাঝি সময়ে আরও এক দফা ক্ষত-বিক্ষত করা হয় লুই আই কানের মূল নকশা। ওই সময় সংসদ ভবনের মূল ভবনের পাশেই খোলা সবুজ চত্বরে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্ট (আইএবি) এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) যৌথভাবে সংসদ সচিবালয় ও গণপূর্তের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রিট করে। রায় আইএবি এবং বাপার পক্ষে গেলেও নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়নি। আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করেই নির্মাণ করা হয় স্পিকার এবং ডেপুটি স্পিকারের বাসভবন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তখন যে প্রতিষ্ঠানটি লুই আই কানের নকশা ধরে কাজ করে, সেই প্রতিষ্ঠানের টাকা সম্পূর্ণ পরিশোধ না করায় তারা তৎকালীন সরকারের হাতে নকশা বুঝিয়ে দেয়নি।
 
সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা যায়, লুই আই কানের প্রায়  ২০ হাজার নকশা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া ইউনিভার্সিটির আর্কিটেকচারাল আর্কাইভে সংরক্ষিত রয়েছে। এসব নকশা সার্চ করার সুযোগ দিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ৩ হাজার ৫৫০ ইউএস ডলার দাবি করেছে। এছাড়া মূল নকশা আনতে খরচ হবে ৪ লাখ ইউএস ডলার।
 
তাদের দাবি অনুযায়ী টাকা দিয়ে নকশা সংগ্রহ করতে চায় সংসদ সচিবালয়। এজন্য অর্থমন্ত্রণালয়ে টাকা চেয়ে চিঠিও দিয়েছে। অর্থমন্ত্রণালয় টাকা ছাড়ের বিষয়টি সংসদ সচিবালয়কে নিশ্চিত করেছে। আগামী ৮/১০ দিনের মধ্যে অর্থমন্ত্রণালয় থেকে টাকা সংগ্রহ করে বাংলাদেশে ব্যাংকের মাধ্যমে  পেনসিলভেনিয়া ইউনির্ভাসিটি কর্তৃপক্ষের ব্যাংক একাউন্টে পাঠানো হবে। তার পরেই লুই আই কানের নকশাগুলো সার্চ করে সংসদ সচিবালয়কে জানাবেন তারা। সেখান থেকে সংসদ সংশ্লিষ্ট নকশাগুলো সংগ্রহ করা হবে।

স্থাপত্য অধিদপ্তরের প্রধান স্থপতি কাজী গোলাম নাসির বাংলানিউজকে বলেন, লুই আই কানের মূল নকশা হয়তো পাওয়া যাবে না। তবে তার স্বাক্ষরিত অনুলিপি আগামী এক, দুই মাসের মধ্যেই আনা সম্ভব হবে।

দেশের কোন স্থপতি বা অন্য কারো কাছে লুই আই কানের নকশার অনুলিপি থাকলে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে তা দেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
 
সরকারি এ স্থপতি আরো বলেন, পেনসিলভেনিয়া ইউনিভার্সিটিতে যতগুলো নকশা আছে, সবই আনা হবে। এখানে একটি বা দুটি নয়, জাতীয় সংসদ ভবনকে কেন্দ্র করে যতগুলো নকশা আছে, সবই আনা হবে। সেভাবেই প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। এতে প্রায় ৪ লাখ ডলার খরচ হবে। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, ৪ লাখ ডলার কোন ব্যপার না। সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, অচিরেই সব পাওয়া যাবে।   
 
এ বিষয়ে সংসদ সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব প্রণব চক্রবর্তী বাংলানিউজকে বলেন, লুই আই কান এর মূল নকশা সংগ্রহে আমরা অনেক অগ্রসর হয়েছি। যেখানে নকশা সংরক্ষিত আছে তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। আশা করি চলতি মাসেই তাদের দাবিকৃত টাকা পরিশোধ করে নকশা সংগ্রহের কাজ শুরু করতে পারবো।
 
তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মূল নকশা সংগ্রহের ব্যাপারে কমিটেড। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) আমাদেরকেও নির্দেশ দিয়েছেন, যত টাকাই লাগুক মূল নকশা সংগ্রহ করতে হবে। যতদূর জানি, প্রায় ২০ হাজারের মতো নকশা রয়েছে। তাই প্রাথমিকভাবে ওরা (যাদের কাছে নকশা) সার্চ করতে আমাদের কাছে ৩ হাজার ৫৫০ ডলার দাবি করেছে। আমরা তা দিতে রাজি হয়েছি। তারা সার্চ করে আমাদের কাংখিত নকশা দেখালে স্থপতি ও বিশেষজ্ঞদের দিয়ে যাচাই করে দেখা হবে কোনটা আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক, সেটাই আনা হবে। যতো দ্রুত সম্ভব মূল নকশা নিয়ে আসবো।
 
এক মাসের মধ্যেই নকশা আনা সম্ভব হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
 
এ বিষয়ে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট (আইএবি) প্রেসিডেন্ট স্থপতি আবু সাঈদ এম আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, যিনি ড্রইং বোঝেন, তাকে যদি পাঠানো হয়, তাহলে সঠিক নকশা আসবে। অন্যথায় অর্ধেক নকশা আসবে কি না বা প্রকৃত নকশা আসবে কি না তা নিয়ে সংশয় থেকে যাবে।
 
তিনি বলেন, সরকারি হোক, প্রাইভেট হোক, যারা ডিজাইন বা নকশা বোঝেন তাদের যেন পাঠানো হয়।
 
এদিকে সংসদ ভবনের (ইন্টারনাল) ভেতরের প্রায় ২০১টি নকশা ইতোমধ্যে সংসদ সচিবালয় হাতে পেয়েছে। যা সংসদে প্রবেশের পথে ও বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শন করা হয়েছে।
 
বাংলাদেশ সময়: ১১০৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০১৫
এসএম/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।