ঢাকা, মঙ্গলবার, ২১ মাঘ ১৪৩১, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৪ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

শিল্প নগরী বগুড়া

চিরতরে থেমে গেছে কটন মিলের সাইরেনের আওয়াজ

বেলাল হোসেন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০১৫
চিরতরে থেমে গেছে কটন মিলের সাইরেনের আওয়াজ ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বগুড়া: রেখে গেলাম দেশের তরে আল্লাহর নামে, সবাই মিলে চালু রাখ তারে-এসব কথাই ভিত্তি প্রস্তর ফলকে লিখে পরপারে চলে গেছেন বগুড়া কটন স্পিনিং কোম্পানি লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা মৌলভী মজিবর রহমান ভান্ডারী। কিন্তু কেউ তার কথা রাখেনি।

বন্ধ মিলটি চালুর উদ্যোগ নেয়নি কেউ।
 
তাই ঐতিহ্যবাহী কটন মিলের সাইরেনের আওয়াজ চিরতরে থেমে গেছে। থেমে গেছে শ্রমিকের দিনরাতের কোলাহল। সে সব এখন শুধুই স্মৃতি। কেননা বেশ কয়েক বছর আগে প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তিসহ সবকিছু বিক্রি করে সব পক্ষের দায়দেনা মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে।
 
এক সময়ের শিল্প নগরীর অতীত ও বর্তমান জানতে অনুসন্ধানকালে ভান্ডারী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ এর প্রতিষ্ঠান বগুড়া কটন স্পিনিং কোম্পানি সম্পর্কে এমন সব তথ্য বেরিয়ে আসে।
 
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৫৩ সালে কোন রকম ব্যাংক ঋণ ছাড়াই মৌলভী মজিবর রহমান ভান্ডারী নিজস্ব তহবিলে শহরের কলেজ রোড এলাকায় ২০ একর জমির ওপর উত্তরাঞ্চলের বৃহৎ এই শিল্প প্রতিষ্ঠানটি স্থাপন করেন। ১৯৫৪ সাল থেকেই এর উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয়।
 
আর এটিই ছিল দেশের একমাত্র কম্বল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। তিনটি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে স্থাপিত এখানকার সুতা কারখানায় ২০ হাজার টাকু, সুতী কাপড় কারখানায় ২১০টি পাওয়ার লুম এবং কম্বল কারখানায় ৮টি বিশেষ ধরনের পাওয়ার লুম ছিল। এছাড়াও শিল্প প্রতিষ্ঠানটিতে ছিল বহু দুর্লভ ও মূল্যবান মেশিন। সার্বিক বিবেচনায় এটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বস্ত্র কারখানা ছিল।
 
এ কারখানায় প্রতিদিন ১০-১২ বেল উন্নতমানের সুতা, ১০০ পিচ কম্বল ও ১০ হাজার গজ কাপড় উৎপাদন হতো। তৎকালীন সময়ে এখানকার উৎপাদিত কম্বল সেনাবাহিনী, বিডিআর, কারাগারগুলোতে সরবরাহের পাশাপাশি দেশের চাহিদা মেটাতো।
 
১৯৯৩ সালের ৪ মে প্রতিষ্ঠাতা মৌলভী মজিবর রহমান ভান্ডারী মারা যান। দায়িত্বে আসেন তার উত্তরসুরীরা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মিলটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে লাভজনক এই প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করা হয়।
 
সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয়করণ অবস্থায় ১০ বছরের মাথায় কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে প্রতিষ্ঠানটির কোটি কোটি টাকা লোকসান হয়। পাশাপাশি যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে মিলটি প্রায় ধ্বংসের মুখে পতিত হয়।
 
এ অবস্থায় তৎকালীন সরকার এক আদেশ বলে ১৯৮২ সালের ১৪ ডিসেম্বর প্রায় ১৩ কোটি টাকা দেনাসহ মিলটি পুনরায় আগের মালিকের কাছে ফেরত দেয়। প্রয়োজনীয় মেরামতের পর তারা মিলটি পরিচালনা করতে থাকেন।
 
কিন্তু সময়ের ব্যবধানে মিলটির আধুনিকায়ন জরুরি হয়ে পড়ে। সে সময় সরকার পক্ষ থেকে কোন আর্থিক সহযোগিতা না পাওয়ায় তা মেরামত করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ফলে উৎপাদন হ্রাস পেতে থাকে। একপর্যায়ে তা লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।  
 
অপরদিকে কাঁচামালের সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অবৈধভাবে ভারতীয় সুতার স্থানীয় বাজার দখল -এসব প্রতিকূল অবস্থার কারণে কোম্পানির অর্থ সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
 
প্রতিষ্ঠানের তৎকালিন জয়েন্ট ডিরেক্টর মতিয়ার রহমান ভান্ডারী ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর হাবিবুর রহমান ভান্ডারী ইন্তেকাল করার পর ১৯৯১ সালে ২৮ জুলাই মিলটি লে অফ ঘোষণা করা হয়। পরে মিলের সম্পত্তি বিক্রি করে সবার পাওনা মিটিয়ে দেওয়া হয়।
 
ভান্ডারী সিটি লিমিটেড’র মার্কেটিং ম্যানেজার মিজানুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, কেবল কটন স্পিনিং কোম্পানি নয়, ভান্ডারী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ’র অধীনে ১০টি শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল। যা এক সময় বগুড়াকে শিল্প শহরে পরিণত করেছিল।
 
কিন্তু অব্যাহত রাজনৈতিক ও আর্থিক অসহযোগিতার কারণে সময়ের ব্যবধানে লাভজনক এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিলুপ্তি ঘটে। বর্তমানে ভান্ডারী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ ‘ভান্ডারী সিটি লিমিটেড’ নামে বহুলতল ভবন নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
 
এই কর্মকর্তা আরও জানান, মালিকরা এসব লাভজনক প্রতিষ্ঠানের করুণ মৃত্যু এখনও মেনে নিতে পারেন না। তারা এখনও এসব প্রতিষ্ঠানের শোকে কাতর। এ কারণে তারা সিংহভাগ সময় ঢাকায় থাকেন।
 
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১৮, ২০১৫
জেডএম                                     

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।