ঢাকা: নির্মাণের দু’বছর পর পণ্য খালাসের কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে পায়রা সমুদ্রবন্দরে। আর একটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হবে দেশের প্রথম এই গভীর সমুদ্রবন্দরটি।
পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার রাবনাবাদ চ্যানেলের তীরে অবস্থিত পায়রা বন্দর দেশের তৃতীয় এবং দক্ষিণ এশিয়ার একটি অন্যতম সামুদ্রিক বন্দর। অবস্থানগত কারণে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাস্তবে উন্নয়ন ও অগ্রগতি তেমনভাবে হয়নি বন্দরটির। অবকাঠামো সুবিধাদির অভাব ও সংলগ্ন মহাসড়ক থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় এখন পর্যন্ত চালুই হয়নি এটি।
২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কলাপাড়া উপজেলার টিয়াখালী ইউনিয়নের ইটবাড়িয়া গ্রামে ভিত্তিফলক উন্মোচনের মধ্য দিয়ে এ বন্দরের উদ্বোধন করেন। তবে গত দু’বছরেও এর পূর্ণাঙ্গ ভিত্তি দেওয়া হয়নি।
অবশেষে প্রকল্পের মাধ্যমে আধুনিক ও যুগোপযোগী হতে যাচ্ছে দেশের একমাত্র এ গভীর সমুদ্রবন্দরটি। ‘পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরের কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও সুবিধাদির উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় বন্দরের উন্নয়ন কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে ডিসেম্বর মাস থেকেই চালু হবে পণ্য খালাস কার্যক্রম।
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পূর্ণাঙ্গ গভীর সমুদ্রবন্দর চালু করতে প্রকল্প তৈরি করে এর ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্প আকারে এটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় প্রকল্পের ব্যয় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। চূড়ান্তভাবে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সভায় অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে পাঠানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের আশাবাদ, দ্রুততম সময়ের মধ্যে অনুমোদনের জন্য একনেক সভায় উত্থাপন করা হবে প্রকল্পটি। এর পরেই শুরু হবে প্রকল্পের কাজ।
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) জিকরুর রেজা খানম বাংলানিউজকে বলেন, দেরিতে হলেও পায়রা বন্দর আধুনিক করতে যাচ্ছি। এটি বাংলাদেশের অনেক সম্ভাবনাময় একটি বন্দর। পদ্মাসেতুর কাজ শুরু হলে বন্দরের গুরুত্ব আরও বেড়ে যাবে। তাই প্রকল্পের মাধ্যমে এটিকে অত্যাধুনিক করা হবে। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে পায়রা বন্দর সিঙ্গাপুরের মতোই উন্নত হবে। এখন দেশের বৈশ্বিক বাণিজ্য সিঙ্গাপুর ঘুরে করতে হচ্ছে। পায়রা বন্দর আধুনিক হলে তা অনেকাংশে কমে যাবে। অনেক আন্তর্জাতিক পণ্যবাহী জাহাজ পায়রা বন্দরে নোঙ্গর করবে। আমাদের দেশের উন্নয়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর।
জিকরুর রেজা খানম বলেন, রামনবাদ থেকে কালীগঞ্জ পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার নৌ-পথ ড্রেজিং করা হবে। এটি একটি প্রাকৃতিক নৌ-পথ। এর যথাযথ ব্যবহার করতে পারলে মাদার ভেসেলও পায়রা বন্দরে নোঙ্গর করতে পারবে।
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, জাতীয় মহাসড়কের সঙ্গে বন্দরের যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে কলাপাড়া উপজেলার রজপাড়া থেকে পায়রা সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত ৫ দশমিক ৬০ কিলোমিটার সড়কও নির্মাণ করা হবে।
তিনি জানান, বর্তমানে ১৬ একর জায়গায় সীমিত ভৌত অবকাঠামোগত সুবিধাদি যেমন, পন্টুন, ক্রেইন, নিরাপত্তা ভবন, অভ্যন্তরীণ রাস্তা ইত্যাদি উন্নয়নের মাধ্যমে একটি বন্দর টার্মিনাল তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু সীমিত অবকাঠামোর কারণে এখনও পণ্য উঠা-নামা, খালাস করা হচ্ছে না। প্রকল্পের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ পায়রা বন্দর ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। একই সঙ্গে বহির্নোঙ্গরে বাণিজ্যিক জাহাজ আনার মাধ্যমে পণ্য খালাস কার্যক্রম আরও জোরদার করা হবে প্রকল্পের আওতায়।
পায়রা সমুদ্রবন্দর পুরোপুরি চালু করা এবং আমদানি-রফতানি পণ্যের অবাধ পরিবহনের লক্ষ্যে একটি প্রশাসনিক ভবন, একটি ওয়্যারহাউজ নির্মাণ করা হবে। অন্যদিকে পাইলট বোট, টাগ বোট, বয়া লেইয়িং ভেসেল, সার্ভে বোট এবং নিরাপত্তা যন্ত্র সামগ্রী সংগ্রহ করে নতুন উদ্যমে শুরু হবে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ।
বর্তমানে এ বন্দর দিয়ে ট্রাক, লরি এবং অন্যান্য যানবাহনে রফতানি ও আমদানিকৃত পণ্য পরিবহনের জন্য পায়রা বন্দর টার্মিনাল থেকে জাতীয় মহাসড়ক পর্যন্ত কোনো সংযোগ সড়ক নেই। প্রকল্প এলাকায় বিদ্যমান বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ কাম সরু রাস্তাটি খেপুপাড়া প্রধান সড়ক থেকে বন্দর পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ। এ রাস্তাটি সরু এবং এর দু’দিকে বসতবাড়ি, গাছপালা ও কলাপাড়া বাজার রয়েছে। ফলে এ সরু রাস্তা দিয়ে আমদানি ও রফতানি পণ্য পরিবহন করা সম্ভব হচ্ছে না।
প্রকল্পের আওতায় এ সমস্যার সমাধানেও নানা পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের জুন মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পের আওতায় নতুনভাবে ৬ হাজার ৭০ একর ভূমি অধিগ্রহণ, এক লাখ বর্গমিটার ওয়্যারহাউজ নির্মাণ এবং রামনবাদ ও কালীগঞ্জ পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার নৌ-পথ ড্রেজিং করা হবে। পাঁচতলা প্রশাসনিক ভবন, ৫ দশমিক ৬০ কিলোমিটার সড়ক, ৫০ মিটার সেতু এবং ৮৪ মিটার বক্স কালভার্টও নির্মাণ করা হবে।
অন্যদিকে পায়রা সমুদ্রবন্দরকে আধুনিক করতে দু’টি পাইলট বোট, একটি টাগ বোট, একটি বয়া লেইয়িং ভেসেল, একটি সার্ভে ভেসেল ও দু’টি সার্ভিস পন্টুন সংগ্রহ করা হবে।
বন্দরের নিরাপত্তার কাজে দু’টি হাইস্পিড বোট, পাঁচটি পিস্তল, ১০০টি শটগান ও ২০ হাজার রাউন্ড অ্যামিউনিশন সংগ্রহ করা হবে।
এর চারপাশের প্রতিরক্ষায় ১২ হাজার ৪শ’ ৮০ বর্গমিটার জিও টেক্সটাইলসহ কনক্রিট ঢাল, ১৬শ’ মিটার দেয়াল, ২শ’ মিটার আরসিসি প্লেট ও ১ লাখ ১৫ বর্গমিটার গ্রেজ টারফিংয়ের(Grass Turfing) ব্যবস্থা থাকবে।
এতে করে দেশের অভ্যন্তরে এবং আঞ্চলিক আমদানি-রফতানি বাণিজ্য প্রসারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০১৫
এমআইএস/এএসআর