ঢাকা, বুধবার, ৮ মাঘ ১৪৩১, ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ২১ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

ভর্তুকিতে ডিজিটাল, বিলুপ্তপ্রায় হাতে আঁকা ব্যানার-ফেস্টুন

সাজেদা সুইটি, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০১৫
ভর্তুকিতে ডিজিটাল, বিলুপ্তপ্রায় হাতে আঁকা ব্যানার-ফেস্টুন ছবি: শাকিল/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: ডিজিটাল পদ্ধতির তোড়ে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে হাতে তৈরি ব্যানার-ফেস্টুনের চল। একদিকে হস্তশিল্পীদের অনেকেই পেশা বদলাচ্ছেন, অন্যদিকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা এতো বেড়েছে যে, ভর্তুকি দিতে বাধ্য হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।


 
রাজধানীসহ দেশের সর্বত্রই প্রায় এমন দশা বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
 
তারা বলছেন, বিলবোর্ড, ব্যানার, লিফলেট, ফেস্টুনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কম্পিউটারে ডিজিটাল পদ্ধতি চলছে। কম সময়ে, চকচকে-ঝকঝকে ছবিসহ পছন্দের সামগ্রী হাতে পেয়ে যাচ্ছেন গ্রাহকরা। হাতে আঁকার দিকে তাই আর আগ্রহী হচ্ছেন না।
 
হস্তশিল্পীদের খুঁজে পেতে কিছুটা গলদঘর্মও হতে হয়। ফকিরেরপুল পানির ট্যাঙ্কির উল্টোদিকে দু’টি দোকানে বিষন্ন ও প্রায় কর্মহীন পাওয়া গেল দু’জন শিল্পীকে।

প্রসঙ্গ আনতেই মো. আমির আর্ট পাবলিসিটি’র আমির হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ব্যবসা নাই। কুনো কাস্টমার নাই। সব ডিজিটাল হয়া গেসে। আমার বান্ধা কাস্টমাররাও আসেন এখন ডিজিটালের লাইগা। অর্ডার নিয়া ডিজিটাল দোকানে নিয়া করায়া দেই। সামান্য আয় হয়।
 
নিজেদের কার্ড দেখান তিনি। সেখানে লেখা- ডিজিটাল ব্যানার, ক্লথ ব্যানার, ফেস্টুন, স্ক্রিন প্রিন্টে ব্যানার প্রিন্ট, প্যানাফ্লেক্স বোর্ড, সাইনবোর্ড, প্রোফাইল লাইট বক্স, ফ্যাক্সো সিল, অটো সিল, ছবি থেকে ছবি, ই-মেইলে ভিসা চেক, ভিজিটিং কার্ডসহ প্রিন্টিংয়ের যাবতীয় কাজ করা হয়।

একজন শিল্পী হয়ে এখন এসব কাজের মধ্যম ব্যক্তি তিনি- জানান কষ্ট লুকিয়ে।
 
ফকিরেরপুলে এ দোকান নিয়ে আমিরের ব্যবসা প্রায় ১৫ বছর ধরে। কিন্তু গত ২/৩ বছর ধরে তেমন কোনো কাজ পাচ্ছেন না তিনি। নিজের দোকান বলেই ব্যবসা বন্ধ করতে হচ্ছে না বটে, টুকটাক যা কিছু আয় হয়, তা দিয়ে কর্মচারীর বেতনটুকু দেন।
 
আমির বলেন, পুরান ব্যবসা, এই কাজ ছাড়া কিছু পারিও না। তাই যেভাবেই হোক চালায়া নিতাছি। পরিচিত বেশিরভাগ লোক (শিল্পী-ব্যবসায়ী) পেটের দায়ে অন্য পেশায় চইলা গেছে।
 
একই অবস্থা অর্পা সাইনের মো. জাবেদেরও।
 
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, জানি না, এমনে কতদিন টিকবার পারুম। শ্যাষে নিজেও ধান্দা-আঁকাবুকি ছাইড়া দেওন লাগবো মন কয়।
 
আমির ও জাবেদ জানান, ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টারে ছবির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এ সমস্যা বেড়েছে। কারণ হাতে না হয় লেখাটা ভালোই করা গেল, কিন্তু হুবহু ছবি আঁকা কষ্টসাধ্য। যে সময় ও শ্রম ব্যয় হয়, সে মূল্য গ্রাহকরা কেন দেবেন? তার চেয়ে খুবই কম সময়ে, কম ব্যয়ে তারা মেশিনে যাচ্ছেন, ডিজিটাল পদ্ধতিতে সেসব করিয়ে নিচ্ছেন।
 
আমির জানান, পল্টনে তাদের একটি সংগঠন আছে- বাংলাদেশ কমার্শিয়াল আর্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশন। কাজ মন্দা, তাই সংগঠনও সেভাবে সক্রিয় নেই এখন।
 
দেশের ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের হস্তক্ষেপ চান এসব শিল্পী-ব্যবসায়ী।  
 
এদিকে কম বিষন্ন নন ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবসায়ীরাও।

পল্টনের মুক্তি ভবনে এভারলাইট মিডিয়া-এর প্রধান কর্মকর্তা মো. শফিউল ইসলাম শিমুল বাংলানিউজকে বলেন, হাতে আঁকা ব্যানার শিল্প প্রায় ধ্বংসের পথে। কিন্তু আমরাও খুব সুবিধায় নেই। এখানে এতো প্রতিযোগিতা বেড়েছে যে, ভর্তুকি দিতে হয়।
 
শিমুল বলেন, গ্রাহক বেড়েছে। চাহিদার পাশাপাশি ব্যাপকতা বেড়েছে ব্যবসায়। প্রতিযোগিতার কারণে আমাদের কাজ বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু লাভ কমে গেছে। এ শিল্পটিও কিছু কারণে হুমকির মুখে। কিছু ব্যবসায়ী রেট কমিয়ে এমন অবস্থায় এনেছেন যে, প্রতিটি প্রোডাক্টে কম-বেশি লোকসান গুনতে হয়।
 
শিমুল বলেন, এ ব্যবসায় ভবিষ্যৎ যেমন হবে বলে সবাই ভেবেছেন, তেমনটা হয়নি। গ্রাহকরা বিভিন্ন ভাবে খরচ কমাতে চান। গ্রাহক ধরে রাখতে তাদের সন্তুষ্টিতে আমরাই লোকসান গুনি। কারণ, ব্যবসাতো চালিয়ে নিতে হবে। কিন্তু এ সবকিছুই সামগ্রিক ব্যবসায় প্রভাব ফেলে।
 
সিটি কর্পোরেশনের নেওয়া অবৈধ বিলবোর্ড উচ্ছেদ অভিযান সমর্থন করেন তিনি। তবে বৈধ-অবৈধ কোনগুলো সেটির সঠিক তদারকি জরুরি বলে মনে করেন।
 
সরকারের কাছে এসব ব্যবসায়ী কিছু চাহিদা তুলে ধরতে চান।
 
তিনি বলেন, আমাদের পণ্যগুলো আমদানির সময় একবার ট্যাক্স দিতে হয়, আবার বিক্রিতে ১৫ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হয়। পরের ট্যাক্সটুকু কমিয়ে যদি ৫ শতাংশ করা যায়, তাহলে লোকসান কম হয়, লাভ ঘরে তুলতে পারি।
 
উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা দেন তিনি, কোনো পণ্য প্রস্তুতে ১৪/১৫ টাকা খরচ পড়ে। কিন্তু সেটি বিক্রি করা যাচ্ছে ১২/১৩ এমনকি ১০ টাকায়। তার অর্থ লাভ নয়, উল্টো লোকসান গোনা হয়।
 
প্রস্তুত সামগ্রীর সবটুকুও কাজে লাগে না, কিছু অপচয় হয়েই যায়। সেটিও লোকসানের খাতায়।
 
এ ব্যবসা টেকাতে সরকার যদি কোনো নীতিমালা করে দেয়, তার সুফল সবাই পাবেন বলেও মনে করেন তিনি।
 
কারখানায় প্রিন্টিং মেশিন দেখিয়ে শিমুল বলেন, এসব মেশিন বিভিন্ন রেঞ্জের মধ্যে পাওয়া যায়। আমেরিকা, জাপান, কোরিয়ায় মেশিন আসে। মোটামুটি ভালো দেখে নিতে গেলে ২৫ লাখ থেকে শুরু করে বেশ ভালোটির দাম পড়বে আড়াই কোটি টাকা পর্যন্ত। যেগুলো যতো দামি, সেগুলো ততো বেশি দিন টেকে। যেমন- ২৫ লাখ টাকার একটি মেশিন বড়জোর ৪/৫ বছর টেকে। তার মানে প্রতিদিন এটি বড় ধরনের একটি নীরব ব্যয়। সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যয়তো আছেই। দামি মেশিনের সাধ্যতো সবার নেই।
 
বাংলাদেশ ডিজিটাল প্রিন্টিং ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য শিমুল বলেন, প্রায় ১৫ বছর ধরে বসুন্ধরা গ্রুপের বিভিন্ন কাজ করি আমরা। এমন বড় গ্রাহকরাই ভরসা। বিভিন্ন লোকসান কাটিয়েও তবু ব্যবসা করে যেতে পারছি। সব ব্যবসায়ী এমনটা পারেন না, তাই তাদের টেকাটাও একটা সময় মুশকিল হয়ে পড়বে।
 
এখানে ডিজিটাল সাইন, ডিজাইন, ব্যানার, প্রিন্টিং, রেডিও-টিভি বিজ্ঞাপন, পত্রিকার বিজ্ঞাপন, ডিজিটাল প্রিন্ট করা হয় বলে জানান তিনি।
 
বাংলাদেশ সময় : ০৯২২ ঘণ্টা, নভেম্বর ০১, ২০১৫
এসকেএস/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।