ঢাকা: বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল হাউজিংয়ের কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম। প্রতিদিন রাজধানীর খিলগাঁও থেকে বাংলামোটরের অফিসে যাতায়াত করেন সিএনজি চালিত অটোরিকশায়।
বরাবরের মতো রোববারও (০১ নভেম্বর) সকাল সাড়ে আটটার দিকে বাসা থেকে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হন নজরুল ইসলাম। কিন্তু রাস্তায় এসে পড়লেন বিপত্তিতে।
সাড়ে আটটা থেকে ৯টা ২০ মিনিট পর্যন্ত প্রায় এক ঘণ্টা ছোটাছুটি করেও কোনো সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালককে মিটারে যেতে রাজি করাতে পারেননি।
এমনকি আগে যেখানে চুক্তিতে চালকরা ১শ’ ৫০ টাকা থেকে ১শ’ ৭০ টাকা চাইতেন, তা বাড়িয়ে চাওয়া হচ্ছে ২শ’ টাকা থেকে ২শ’ ২০ টাকা পর্যন্ত।
এক ঘণ্টার ছোটাছুটির পর কোনো অটোরিকশা চালককে রাজি করাতে না পেরে এক পর্যায়ে স্বাভাবিক কারণেই মেজাজ হারিয়ে ফেললেন এই বেসরকারি কর্মকর্তা। এক চালকের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কেও জড়িয়ে পড়লেন তিনি। কিন্তু তাতেও লাভ হলো না। উল্টো চালকই উদ্ধত কণ্ঠে হাত নাড়িয়ে শাসিয়ে দিলেন নজরুল ইসলামকে। চড়া গলায় বললেন, ‘মিটারে যামু না, কি করবেন করেন’।
উপায়ন্তর না পেয়ে ২শ’ টাকা ভাড়া চুক্তিতে অন্য আর একটি সিএনজি চালিত অটোরিকশা চেপে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হন এই বেসরকারি কর্মকর্তা।
এটি শুধু এক নজরুল ইসলামের ঘটনা নয়। প্রতিনিয়ত রাজধানীতে অসংখ্য নাগরিক সিএনজি চালিত অটোরিকশা ভাড়ার এমন অরাজকতার মুখোমুখি হচ্ছেন।
এ অরাজকতা বন্ধের উদ্দেশ্যে সরকার ভাড়া দ্বিগুণ বাড়ানো ও মিটারে চলাচল করা বাধ্যতামূলক করলেও তার সুফল মিলছে না। এছাড়া কোনো অটোরিকশা চালক মিটারে না চললে ডাম্পিং করার ঘোষণাও দিয়েছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)।
নতুন এ নিয়ম চালুর প্রথম দিনে রোববার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, হাতেগোনা কয়েকটি সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালক মিটারে চলাচল করলেও অধিকাংশই তা মানছেন না।
সকাল থেকে রামপুরা, খিলগাঁও, মতিঝিল ও যাত্রাবাড়ীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে মিটারে অটোরিকশা চলাচল করতে দেখা যায়নি। যাত্রী সেজে এ অঞ্চলগুলোতে ১৩টি চালকের সঙ্গে কথা হয়। তাদের কেউ মিটারে যেতে রাজি হননি।
এদিকে গুগল ম্যাপ বলছে, খিলগাঁও থেকে বাংলামটরের দূরত্ব ৪ কিলোমিটার। প্রথম ২ কিলোমিটার ৪০ টাকা এবং পরবর্তী প্রতি কিলোমিটার ১২ টাকা হিসেবে খিলগাঁও থেকে বাংলামোটরের ভাড়া হয় ৬৪ টাকা। এর সঙ্গে যানজটের প্রতি মিনিট ২ টাকা হিসাবে ১০ মিনিট যানজট ধরলেও সর্বোচ্চ ভাড়া হয় ৮৪ টাকা।
বিষয়টি উপস্থাপন করতেই নজরুল ইসলামের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়া সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালক নিজেকে আলম পরিচয় দিয়ে বলেন, আমি ২শ’ টাকার নিচে যাবো না। আপনার পোষালে যাবেন, না পোষালে যাবেন না।
সরকারতো মিটারে চলাচল করা বাধ্যতামূলক করেছে, তা হলে আপনি মিটারে যাবেন না কেন? এমন প্রশ্ন করা হলে এই চালক পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, আপনাকে এতো ব্যাখ্যা দিতে পারবো না। সরকার তো কতো কিছুই বাধ্যতামূলক করে। এর মধ্যে কয়টির বাস্তবায়ন?
গুগল ম্যাপে দেখা যায়, রামপুরা থেকে মতিঝিলের দূরত্ব ৫ কিলোমিটার। সে হিসেবে সরকার নির্ধারিত ভাড়া অনুযায়ী সিএনজি চালিত অটোরিকশায় যাতায়াতের জন্য যাত্রীদের ভাড়া গুণতে হবে ৭৬ টাকা। এর সঙ্গে ১৫ মিনিটের যানজট ধরলে সর্বসাকুল্যে ভাড়া ১০৬ টাকার বেশি হওয়ার কথা না।
তবে রামপুরা কাঁচাবাজারের সামনে থেকে তিনজন চালকের সঙ্গে কথা বললে কেউ ১৬০ টাকার নিচে যেতে রাজি হননি। এমনকি একজন ২২০ টাকাও চেয়ে বসেন।
রামপুরা থেকে গাবতলীতে যাওয়ার ক্ষেত্রে গুগল ম্যাপ বলছে, দু’টি সড়ক ব্যবহার করা যায়। এর মধ্যে তেজগাঁও শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সরণি হয়ে মিরপুর সড়ক ধরে গেলে রাস্তার দূরত্ব দাঁড়ায় ১১ কিলোমিটার। আর মোহাম্মদপুর সড়ক হয়ে গেলে দূরত্ব বেড়ে হয় ১৩ কিলোমিটার।
এ দূরত্ব ধরে সিএনজি চালিত অটোরিকশার ভাড়া কিছুতেই ২২০ টাকার বেশি হওয়ার কথা না। এর মধ্যে রামপুরা-গাবতলীর দূরত্ব ১৩ কিলোমিটার ধরলে প্রকৃত ভাড়া আসে ১৭২ টাকা। এর সঙ্গে ২০ মিনিট যানজট ধরলে যানজটের জন্য ভাড়া বাড়ে ৪০ টাকা। সে হিসেবে মোট ভাড়া দাঁড়ায় ২১২ টাকা।
কিন্তু রামপুরার ওয়াপদা মোড় থেকে দু’জন চালকের সঙ্গে কথা বললে কেউ মিটারে যেতে রাজি হননি। আর চুক্তিতে ভাড়া চান একজন ৩শ’ টাকা, অন্যজন ৩২০ টাকা।
মিটারে চলাচল করা বাধ্যতামূলক করার পরও এভাবেই প্রকৃত ভাড়ার চেয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে দেড়-দুই গুণ বেশি ভাড়া আদায় করে নিচ্ছেন সিএনজি চালকরা।
যাত্রাবাড়ীতে গিয়েও অটোরিকশা ভাড়ার এ অরাজকতা দেখা গেছে। গাবতলী থেকে যাত্রাবাড়ী রাস্তার দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার। যাত্রাবাড়ী মোড় থেকে চারজন চালকের কেউ মিটারে যেতে রাজি হননি।
তাদের মধ্যে দু’জন চুক্তিতে ভাড়া চান ৪শ’ টাকা, একজন ৩শ’ ৮০ টাকা এবং অন্যজন ৪শ’ ২০ টাকা ভাড়া দাবি করেন। তবে ভাড়া দ্বিগুণ বাড়ানোর পরও এ রুটের প্রকৃত ভাড়া কিছুতেই ৩শ’ টাকার ওপরে হওয়ার কথা না।
এর মধ্যে ১৮ কিলোমিটেরের প্রকৃত ভাড়া ২৩২ টাকা। এর সঙ্গে ৩০ মিনিট যানজটের জন্য ২ টাকা হিসেবে ভাড়া আরও ৬০ টাকা যোগ করলে মোট ভাড়া হয় ২৯২ টাকা। এ ক্ষেত্রেও সিএনজি ভাড়ার অরাজকতার হাত থেকে রেহাই মিলছে না যাত্রীদের।
অবশ্য রাজধানীতে সিএনজি চালিত অটোরিকশা ভাড়ার এ অরাজকতা নতুন নয়। এর আগেও ২০১০ সালে ভাড়ার অরাজকতা বন্ধের জন্য সৈয়দ আবুল হোসেন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী থাকাকালে ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন।
এরপর দুই দফা সময় বাড়িয়ে ২০১১ সালের ১৬ জানুয়ারি থেকে বাড়তি ভাড়া কার্যকর করা হয়। অবশ্য এরপর ওই বছরেই আরও দুই বার ১৯ মে ও ১৯ সেপ্টেম্বর অটোরিকশার ভাড়া বাড়ানো হয়। এতে ২০১০ সালের তুলনায় ভাড়া বেড়ে দাঁড়ায় দ্বিগুণেরও বেশি।
তবে ভাড়া বাড়িয়ে সে সময়ও বন্ধ করা সম্ভব হয়নি এ নৈরাজ্য।
আর সর্বশেষ রোববার থেকে ভাড়া বাড়িয়ে আবারও দ্বিগুণ করা হয়েছে। নতুন নির্ধারিত ভাড়া অনুযায়ী, সিএনজি চালিত অটোরিকশায় যাতায়াতের জন্য যাত্রীদের প্রথম দুই কিলোমিটারের ভাড়া দিতে হবে ৪০ টাকা, যা আগে ছিলো ২৫ টাকা। পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ১২ টাকা, যা আগে ছিলো ৭ টাকা ৬৪ পয়সা। আর বিরতির সময়ে (যানজটে আটকে থাকলে) বাড়তি যোগ হবে প্রতি মিনিট ২ টাকা, যা আগে ছিলো ১ টাকা ২৫ পয়সা।
দ্বিগুণ ভাড়া বাড়িয়ে এবারও বন্ধ হয়নি সিএনজি চালিত অটোরিকশার দীর্ঘদিন ধরে চলা ভাড়া নৈরাজ্য। রোববার সকালের রাজধানীর চিত্র সে কথাই বলছে।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ০১, ২০১৫
এএসএস/এএসআর
** অটোরিকশা মিটারে চলে না, মিটারে চলে!
** অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে