ঢাকা, সোমবার, ৬ মাঘ ১৪৩১, ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

খুলনার মাদক সম্রাট শাহজাহান আটক

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০১৫
খুলনার মাদক সম্রাট শাহজাহান আটক ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

খুলনা: খুলনার অপ্রতিরোধ্য মাদক সম্রাট শাহজাহান হাওলাদারকে অবশেষে আটক করতে সক্ষম হয়েছে গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।

শাহজাহান হাওলাদার বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ উপজেলার উত্তর কুমারিয়া জোলার আব্দুল মজিদ হাওলাদারের (মিস্ত্রি) ছেলে।



বৃহস্পতিবার (৫ নভেম্বর) বেলা ১১টায় নগরীর খুলনা ক্লাব সংলগ্ন পুলিশ লাইনের সামনের সড়ক থেকে ১৮ বোতল মদসহ তাকে আটক করা হয়।

মহানগর ডিবির উপ-পরিদর্শক (এসআই) বাহাউদ্দীন দুপুর ২টায় এ তথ্য বাংলানিউজকে নিশ্চিত করেন।

তিনি বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তার নেতৃত্বে শাহজাহানকে আটক করা হয়। শাহজাহানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় এক ডজনেরও বেশি মাদক মামলা রয়েছে।

শাহজাহান হাওলাদার দীর্ঘদিন ধরে কৌশলে খুলনা এবং আশপাশের কয়েকটি জেলায় দেশি-বিদেশি মদ এবং বিয়ারের ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন। এ ব্যবসার মাধ্যমে তিনি কোটি কোটি টাকার পাহাড় গড়ে মাদক সম্রাট হিসেবে খ্যাত হয়েছেন।

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র মনিরুজ্জামান মিঠু বাংলানিউজকে জানান, মহানগর ডিবির ১৫ দিনের এক বিশেষ অভিযান চলছে। যার অংশ হিসেবে মাদক সম্রাট শাহজাহানকে আটক করতে সক্ষম হয়েছে ডিবি। বর্তমানে শাহজাহানকে ডিবি কার্যালয়ে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

কয়েকটি গোপন সূত্রে জানা যায়, মাদক ব্যবসা পরিচালনার জন্য তার ৩০ জন বেতনভ‍ুক্ত লাইনম্যান রয়েছেন। শুধুমাত্র মোবাইলে ফোন করলেই লাইনম্যানরা নির্দিষ্ট স্থানে মাদক পৌঁছে দিয়ে টাকা বুঝে নেন। সম্প্রতি তিনি তার ব্যবসাকে আরও ডিজিটালাইজড করেছেন। এক্ষেত্রে বিকাশের মাধ্যমে আগে টাকা পাঠালে দ্রুত মাদক পৌঁছে যায়।

এছাড়াও তার অধীনে রয়েছে প্রায় এক ডজন নারী সদস্য। এসব নারীদের স্ত্রী সাজিয়ে নগরীর অভিজাত এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে শাহজাহান গড়ে তুলেছেন মাদকের আড়ত। এসব গোপন আড়ত থেকে সে মদ সরবরাহ করেন শহর জুড়ে। এ পর্যন্ত তার কয়েকজন স্ত্রীর সন্ধান পেয়েছে প্রশাসন। যার মধ্যে মুন্নী আক্তার, পারুল ও ফরিদা পারভিন উল্লেখযোগ্য।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকা থেকে ১৪৫ বোতল বিদেশি মদ ও ৭২ ক্যান বিয়ার নিয়ে খুলনায় আসার পথে খানজাহান আলী (র.) সেতু এলাকা থেকে পুলিশ সিলভার কালারের একটি প্রাইভেটকার আটক করে। প্রাইভেটকারটি আটকের সময় কামাল জমাদ্দার ও শাহজাহান নামে দু’মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা ওই মাদক খুলনার মাদক সম্রাট শাহজাহান হাওলাদারের বলে স্বীকার করেন।
 
একইভাবে ২০১১ সালের ২৭ মার্চ রাত ১২টার দিকে পুলিশ নগরীর ইউসুফ রো’র ৩ নম্বর মির্জাপুরে শাহজাহানের বাড়িতে অভিযান চালায়। ওই সময় বাড়ির সিঁড়ির নিচের দু’টি গোডাউন ও দোতলার বিভিন্ন কক্ষ থেকে ৬৪০ বোতল দেশি-বিদেশি মদ, এক হাজার ৬০৮ ক্যান বিয়ারসহ নানা প্রকার মাদকদ্রব্য উদ্ধার করে। অভিযানের সময় তালাবদ্ধ কক্ষ থেকে একটি একনলা বন্দুক ও ৮ রাউন্ড বন্দুকের কার্তুজ ও নগদ ৯০ হাজার ৭৫০ টাকা, একটি বৌদ্ধমূর্তি, একটি স্বর্ণের সাদা পাথর সম্বলিত আংটি, বিভিন্ন মডেলের ৯টি মোবাইল সেট, একছড়া চাবি ও ৮টি ৫শ’ টাকার জাল নোটও উদ্ধার করা হয়।

এ ঘটনায় শাহজাহানের স্ত্রী ফরিদা পারভীন, তার ছেলে জুলফিকার আলী খান ওরফে শুভ, মেয়ে ফাতেমাতুজ জোহরা মহুয়া, বাড়ির ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ ও কাজের মেয়ে রেশমা আক্তারকে আটক করে পুলিশ। কিন্ত শাহজাহানকে গ্রেফতার করতে পারেনি। এ মামলায় শাহজাহান ও তার পরিবারের সদস্যসহ সাতজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। তবে আসামিরা সকলেই আদালত থেকে জামিন নিয়েছে।
 
এরপর ২০১৩ সালের ২৮ এপ্রিল পুলিশ নগরীর সিমেট্রি রোডের একটি আবাসিক ভবনে অভিযান চালিয়ে শাহজাহানের ২২ লক্ষাধিক টাকা মূল্যের প্রায় ৫শ’ বোতল দেশি-বিদেশি মদ ও বিয়ার উদ্ধার করে। নগরীর সিমেট্রি রোডে বিএনপি নেতা আব্দুল জলিল খান কালামের বাসার দ্বিতীয় তলা ভাড়া নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ মাদকদ্রব্যের আড়ত গড়ে তুলেছিলেন শাহজাহান।

জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ জিয়াউদ্দীনের নেতৃত্বে ওই গোডাউনে অভিযান চালিয়ে ২৬৬ ক্যান বিয়ার, ২২১ বোতল দেশি-বিদেশি মদ এবং মদ বিক্রির ১২ হাজার ৮শ’ নগদ টাকা উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে কেরু অ্যান্ড কোং, ভোদকা, হুইস্কি, ভ্যাট ৬৯, স্পিকার লাইনসহ ২৫ প্রকারের দেশি-বিদেশি মদ ছিল। তবে পুলিশ সেবারও শাহজাহানকে ধরতে পারেনি। এমনকি এ মামলায় শাহজাহানকে আসামি পর্যন্ত করা হয়নি।
 
সবশেষ চলতি বছরের ১৮ আগস্ট নগরীর সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকার একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ ও বিয়ার উদ্ধার করে র‌্যাব। এ সময় মাদক ব্যবসায়ী শাহাজাহান হাওলাদারের স্ত্রী ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মুন্নি আকতারকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এ সময় ওই বাড়ি থেকে বাংলাদেশের কেরু অ্যান্ড কোম্পানি এবং স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের নানা ব্রান্ডের ৪৫৫ বোতল মদ ও ৭৩৬ ক্যান বিয়ার এবং দু’টি মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার করা মাদকদ্রব্যের মূল্য ৩৬ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। তবে এ সময়ও শাহজাহানকে পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় নগরীর সোনাডাঙ্গা থানায় মামলা হয়েছে।

সূত্রে জানা যায়, ২০০৪ সালের ৩ আগস্ট নগরীর রয়্যাল হোটেল থেকে নগর গোয়েন্দা পুলিশ শাহজাহান হাওলাদারকে গ্রেফতার করে। তবে গ্রেফতারের কিছু দিনের মধ্যেই শাহজাহান জামিনে বেরিয়ে আসে।

জানা গেছে, শাহজাহান প্রথমে নগরীর রূপসায় সামান্য মাছ ব্যবসা করতেন। পরে মাদক ব্যবসা করে শাহজাহান নগরীতে একাধিক মার্কেট গড়ে তুলেছেন। এছাড়া মাদকের টাকায় বাগানবাড়িসহ রয়েছে তার কোটি কোটি টাকার সম্পদ। সে সর্বাধুনিক মডেলের দামী গাড়িতে বিলাসিতার সাথেই চলাফেরা করে থাকেন।

কোটিপতি এ মাদক সম্রাট দুই যুগেরও বেশি সময় পদ্মার এপারের অধিকাংশ জেলায় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশি মদ ও বিয়ার সরবরাহ করে আসছেন। নগরীর অভিজাত সব আবাসিক হোটেল এবং বিভিন্ন ভিআইপি ক্লাবে তার লাইনম্যান মদ ও বিয়ার সরবরাহ করে থাকে। শাহজাহান চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর এবং ঢাকা থেকে এসব মাদকদ্রব্য খুলনায় আনে। এগুলো বিকিকিনির কাজে রয়েছে তার বিশ্বস্ত অর্ধশতাধিক কর্মী। কর্মীরা মাঝে মধ্যে ধরা পরলেও মাদক সম্রাট শাজাহান ছিলো ধরাছোঁয়ার বাইরে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫২৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০১৫
এমআরএম/আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।