শেরপুর (বগুড়া) থেকে ফিরে: স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৪ বছর পার হলেও, শহীদদের আত্মত্যাগের ঘটনা আগামী প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় করে রাখতে বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় আজও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো সংরক্ষণের জন্য বারবার লিখিত ও মৌখিকভাবে জানানো হলেও সংশ্লিষ্টরা কোনো ব্যবস্থা নেননি।
এ দীর্ঘ সময়ে উপজেলায় দুইটি গণকবর সংরক্ষণের জন্য নিরাপত্তা প্রাচীর ও নামফলক স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে গেলো বছর কল্যাণী গ্রামে গণকবর চিহ্নিত করে সেখানে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।
বাকিগুলোর অবস্থা অত্যন্ত করুণ। অথচ যুদ্ধে উপজেলার দড়িমুকুন্দ, কল্যাণী, ঘোগা, গোপালপুর, বাগড়া কলোনিতে যে নির্মম গণহত্যা চালানো হয়েছিলো, তা শুনলে এখনও গা শিউরে ওঠে।
দড়িমুকুন্দ গণকবর
১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল শেরপুর উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের দড়িমুকুন্দ গ্রামে পাকসেনারা নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়।
সেদিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া হাবিবুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, দিনটি ছিলো ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল। মাত্র সাতজন পাকমিলিটারি তাদের দড়িমুকুন্দ গ্রামে হানা দেয়। তারা গ্রামের লোকদের ডেকে নিয়ে গ্রামের প্রবেশ পথের দু’ধারে লাইনে দাঁড় করিয়ে দেয়। পরে তারা ২৪ জন স্বাধীনতা মুক্তিকামীকে গুলি করে হত্যা করে। তারপর পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেয় গ্রামের প্রতিটি বাড়ি। নিমিষেই মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় দড়িমুকুন্দ গ্রাম।
পাকসেনাদের গুলিতে আজাহার আলী ফকির, ওসমান গণি ফকির, আজিজুর রহমান, একরামুল হক, সুজার উদ্দিন, সেকেন্দার আলী, বুল মাজন মিয়া, রমজান আলী, মোখলেছুর রহমান, ইসাহাক আলী, আবেদ আলী, আলিমুদ্দিন, ছোবহান আলী, গুইয়া প্রামাণিক, দলিল উদ্দিন, হাসেন আলী, উজির উদ্দিন, আয়েন উদ্দিন, আফজাল হোসেন, মোহাম্মাদ আলী, আজিমুদ্দিন, নেওয়াজ উদ্দিন, হায়দার আলী ও জপি প্রামাণিক শহীদ হন।
পরে পাকসেনারা গ্রাম ছেড়ে চলে গেলে ভীত-সন্ত্রস্ত লোকজন ঘটনাস্থলের পাশেই নিহতদের কবর দিয়ে রাখেন। ২০০২ সালের ২৬ মার্চ শেরপুর উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সেখানে একটি নামফলক তৈরি করা হয়। গণকবর সংরক্ষণের জন্য দেওয়া হয় নিরাপত্তা প্রাচীর।
কল্যাণী গণকবর
উপজেলার সুঘাট ইউনিয়নের কল্যাণী গ্রামে ১৯৭১ সালে পাকাহানাদার বাহিনীর হাতে ২০ জন স্বাধীনতাকামী জীবন দেন। তারা হলেন- বীরেন্দ্রনাথ পাল, যজ্ঞেশ্বর পাল, ঢলু পাল, মতিলাল পাল, হারান পাল, সুদেব পাল, রাজেন পাল, লাল বিহারী পাল, চিত্ত পাল, কৃষ্ণ পাল, ক্ষুদিরাম পাল, রাধিকা নাথ পাল, মনিন্দ্র মোহন্ত, বাদুলী পাল, মনিন্দ্র নাথ পাল, নারায়ণ পাল, মনিন্দ্র নাথ প্রকৌশলী, পুষ্প পাল, নেংড়া পাল ও শ্রীবাস শীল।
২০১৪ সালের বিজয়ের মাসে উপজেলা প্রশাসন ও বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ শেরপুর উপজেলা কমান্ডের উদ্যোগে গণকবর চিহ্নিত করা হয়। সেখানে ইউনিয়ন পরিষদের অর্থায়নে নামফলকসহ নির্মাণ করা হয় শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ।
বাগড়া কলোনি বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের শেষ দিকে উপজেলার কুসুম্বী ইউনিয়নের বাগড়া কলোনিতে পাকসেনারা আক্রমণ চালায়। স্বাধীনতাকামী গ্রামবাসী মিছিল নিয়ে রাস্তায় বের হলে তাদের ওপর নেমে আসে হায়েনাদের তাণ্ডব।
যুদ্ধাহত ফরিদ উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, আমার বাবা সদর আলী সরকারসহ গ্রামের লোকজন বাঙালির স্বাধীনতার পক্ষে মিছিল নিয়ে গ্রামের পাশের প্রধান সড়কে যান। রাজাকাররা এ খবর পাক সেনাদের কাছে পৌঁছে দেয়। তখন বেলা অনুমান সাড়ে ১০টা হবে। পাকসেনারা এসে মিছিলকারীদের ঘেরাও করে।
পরে তাদের ধরে নিয়ে সেনারা মনছের আলীর ইটখোলায় যায়। ইটখোলার ভেতরে তাদের লাইনে বসিয়ে দিয়ে মেশিনগানের গুলি চালায়। মুহূর্তেই ৩২ জন স্বাধীনতাকামী লাশ হয়ে যান। এসময় বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হন। যে ইটখোলায় রাত দিন লেলিহান শিখার উদগীরণ হত, সেই ইটখোলা নিমিষেই শহীদদের রক্তে সিক্ত হলো। তপ্ত ইটগুলোর দীর্ঘদিনের তৃষ্ণা যেনো পাক হায়েনারা মিটিয়ে দিলো স্বাধীনতাকামী শহীদের রক্ত দিয়ে।
গুলিবিদ্ধ যুদ্ধাহত এলাচী বেওয়া, ফরিদ উদ্দিনসহ একাধিক ব্যক্তি বলেন, শহীদদের ১০থেকে ১২ জনকে গ্রামের পূর্বপাশের একটি ভিটায় কবর দেওয়া হয়। এ স্থানটি বর্তমানে কয়েকটি তাল গাছ দিয়ে ঘেরা রয়েছে। এখানে আর ইটখোলা নেই। কোনো নামফলক বা স্মৃতিসৌধ গড়ে ওঠেনি। অনেকেই জানে না এই বধ্যভূমির কথা।
এলাকাবাসী সূত্রে যাদের নাম পাওয়া যায় তারা হলেন-আফসার মণ্ডল, শরকত মণ্ডল, আলী আকবর মণ্ডল, আয়েজ উদ্দিন মণ্ডল, আলতাব সেখ, সিফাত মোল্লা, কুদ্দুস, হোসেন, মনছের, খোকা, আফজাল, ঈমান, হজরত, অাবদুস সাত্তার, রিয়াজ উদ্দিন, যদিমুদ্দিন, সদর আলী সরকার, আজিজ ও নবা ফকির।
ঘোগাব্রিজ ও গোপালপুর বধ্যভূমি (খাগা হিন্দুপাড়া)
নির্দিষ্ট দিন-তারিখ জানা না গেলেও এপ্রিলের কোনো একদিন পাকসেনারা ঘোগাবিজ্র ও গোপালপুর এলাকায় ব্যাপক গণহত্যা চালায়।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের শেরপুর উপজেলা কমান্ডের নেতা ইমান আলী বাংলানিউজকে জানান, পাকসেনারা ঘোগাব্রিজ এলাকায় প্রায় ৩শ জন ও গোপালপুর এলাকায় ১৮ থেকে ২০ জন স্বাধীনতাকামীকে হত্যা করে। সংরক্ষণের অভাবে স্বাধীনতার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ স্থানগুলো বর্তমানে চেনার কোনো উপায় নেই।
বধ্যভূমি সংরক্ষণে প্রশাসনের পদক্ষেপ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বক্তব্য
স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৪ বছর পার হলেও শহীদদের গণকবরগুলো সংরক্ষণে প্রশাসন কার্যকারী কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ৪৪ বছর ধরে স্থানীয় প্রশাসন কেবল পরিকল্পনা নিয়েই চলছেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) একেএম সরোয়ার জাহান বাংলানিউজকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে অতি অল্প সময়ের মধ্যে এসব স্থান সঠিকভাবে নিরুপণ করা হবে। এরপর সেগুলো সংরক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট অধিদফতরকে জানানো হবে। পরবর্তীতে তাদের দেওয়া দিক নিদের্শনা অনুযায়ী শহীদদের স্মৃতিগুলো রক্ষায় নেওয়া হবে কার্যকারী উদ্যোগ।
তবে তার ও মুক্তিযোদ্ধাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গত বছর কল্যাণী গ্রামে গণকবর চিহ্নিতকরণ এবং সেখানে শহীদদের নামফলকসহ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয় বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ শেরপুর শাখার কমান্ডার ওবায়দুর রহমান, সাবেক কমান্ডার তোফাজ্জল হোসেন ও মুক্তিযোদ্ধা ইমান আলী বাংলানিউজকে জানান, গণকবর বা বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের জন্য সরেজমিন শেষে ২০১১ সালের জুন-জুলাই মাসে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। সেসময় তিনি সেই প্রতিবেদন তার ঊর্ধ্বতন দফতরে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু অদ্যবধি পর্যন্ত এর কোনো বাস্তব ফল পাওয়া যায়নি।
ওই মুক্তিযোদ্ধারা আক্ষেপ করে বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমান সরকারের সময় ওই স্থানগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা না করলে সামনের দিনে হয়তো আর কোনো সরকার উদ্যোগ নেবে না। এতে আগামী প্রজন্ম স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস-ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলবে।
হয়তো কালের আবর্তে ইতিহাসের পাতা থেকে শেরপুরে মুক্তিযুদ্ধের শেষ স্মৃতিগুলো হারিয়ে যাবে বলেও মুক্তিযোদ্ধারা মনে করেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৫২২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৫
এএটি/এসএস