ঢাকা: শুধু দুঃখ আর কষ্টে নয়, মানুষ কাঁদে নানা কারণে। কাঁদে আরও কিছু অনুসঙ্গে।
আলোকচিত্র দেখে সেই সীমাহীন বেদনা পরিপূর্ণ অনুভব করা না গেলেও অনুধাবন করা যায় অনেকটা।
বিজয় দিবস উপলক্ষে বুধবার (১৬ ডিসেম্বর) রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে আগত দর্শনার্থীরা যেন সেই অনুধাবনই করেছেন। আর মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকাময় চিত্র দেখে নিরবে কেঁদেছেন।
এখানকার ছবিতে জড়িয়ে আছে একাত্তর। আছে আপনজনের স্মৃতির খণ্ডচিত্র। ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন মরদেহ। আছে শরণার্থীদের ঘর ছেড়ে পালানোর দৃশ্য। হানাদার বাহিনীর নারী ও শিশু নির্যাতনে বিভৎসতা। এসব স্থিরচিত্র দেখে শত শত মানুষের চোখে এসেছে পানি, কেঁদেছে তাদের হৃদয়।
এমন সব ছবি নিয়েই চার দিনব্যাপী চলছে আলোকচিত্র প্রদর্শনী। আর এ প্রদর্শনীর নাম দেওয়া হয়েছে ‘৭১ ফ্রেমে একাত্তর’। আয়োজন করেছে ‘রক্তস্নাত বিজয়’ নামে একটি সংগঠন।
প্রদর্শনীতে একদিকে স্থান পেয়েছ যুদ্ধের বিভিন্ন সময়ের ৭১টি ছবির ফ্রেম। যে ছবিতে চিত্রিত হয়েছে একাত্তরে বাঙালির যুদ্ধে যাওয়া, প্রতিরোধ, বাস্তুচ্যুতি, নির্যাতন, বিশ্বমানবতা, ঘরে ফেরা, যুদ্ধের প্রস্তুতি, অমানবিক দৃশ্য ও বিজয়। অন্যদিকে, স্থান পেয়েছে রক্তস্নাত বিজয় সংগঠনের বিভিন্ন ছবি।
বাস্তুচ্যুতি শিরোনামের ফ্রেমে একটি ছবিতে বোনের মরদেহ। ভাই তার নিথর দেহটি দু’হাতে নিয়ে অজানা গন্তব্যে যাচ্ছেন। ছবিটি দেখে বেশ কিছুক্ষণ চুপ রইলেন সায়েদা আকতার। যুদ্ধ দেখেননি তিনি। তাতে কী হয়েছে? সেই চেতনাকে তো ধারণ করেন। ভালোবাসেন দেশ, মাটি ও মানুষকে।
একাত্তরের বিরল সব ছবি নিয়ে এই প্রদর্শনী খবর সায়েদা তার এক বন্ধুর কাছে শুনেছেন। সে খবরে যাত্রাবাড়ী থেকে স্বামীর সঙ্গে এসেছেন তিনি। প্রদর্শনী খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলেন। এসব ছবি দেখে তার হৃদয় নিরবে কেঁদেছে বলেও জানান তিনি।
সায়েদা আকতার বলেন, মায়ের কাছে যুদ্ধের ঘটনা শুনেছি। কিন্তু তখন এতোটা খারাপ লাগেনি। অনুভবও করতে পারিনি যুদ্ধের বিভৎসতা ও বর্বরতা কী পরিমাণ ছিলো? কিন্তু এখানে এসে যা দেখলাম, তা হৃদয় ছুয়েছে, কান্নাও পেয়েছে।
সায়েদার স্বামী আকতার জামিল বাংলানিউজকে বলেন, পাকিস্তান দাবি করেছে তারা নাকি একাত্তরে কোনো গণহত্যা চালায়নি। কিন্তু এসব ছবি কী প্রমাণ করে? তাদের হাত থেকে আমাদের দেশের মা ও বোনেরা রক্ষা পায়নি। তাহলে তারা কী করে বলে একাত্তরে গণহত্যা হয়নি?
প্রদর্শনী ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন ফ্রেমের ছবি দেখে কেউ কেউ চোখ মুচছেন। কেউ আবার অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। এসব ছবি স্মৃতির আখরে ধরে রাখতে অনেকে মোবাইলে ছবিও তুলেছেন। কেউবা আবার তুলছেন সেলফি।
একাত্তরে হানাদার বাহিনী কতটা বর্বরতা চালিয়েছিলো, যারা বিষয়টি জানেন না তারা কিছুটা হলেও ধারণা পেয়েছেন এই প্রদর্শনীর ছবিগুলো দেখে। চারদিনে প্রায় দুই লাখ মানুষ এ প্রদর্শনী দেখতে আসবে বলে ধারণা করছে আয়োজক কমিটি।
যেসব বাঙালি ও বিদেশি আলোকচিত্রীর ছবি এই প্রদর্শনীতে ব্যবহার করা হয়েছে। তারা হলেন- রশিদ তালুকদার, আমানুল হক, রফিকুল ইসলাম, জামাল উদ্দিন, সাইয়েদা খানম, আফতাব আহমেদ, আনোয়ার হোসেন, মোয়াজ্জেম হোসেন, রঘু রাই, কিশোর পারেখ, রবিন দাশ, অমিয় তরফদার, হেনরি স্টেনহেঞ্জ, ডন ম্যাকালিন, গ্যাভিন ইয়ং, হেনরি, মার্ক টিবাউড, মার্লিন সিলভার স্টোন ও মার্ক গডফ্রে প্রমুখ।
দেশীয় কাপড়ের ওপর প্রিন্ট করে ছবি প্রদর্শন করা হচ্ছে বলে জানালেন আয়োজক কমিটির সহ-সচিব নাজমুল হোসেন।
ছবির প্রদর্শনীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, একাত্তর সালে পাকিস্তান যে গণহত্যা ও নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তা নতুন প্রজন্মকে জানাতেই এই প্রদর্শনী।
এখানে এমন কিছু দর্লভ ছবি প্রদর্শন করা হয়েছে, যা কেউ আগে কখনও কোনো প্রদর্শনীতে দেখেননি। ফলে এসব ছবি দেখলে তারা একাত্তরের বর্বরতা সম্পর্কে অন্যরকম এক ধারণা পাবেন বলে জানান নাজমুল হোসেন।
বাংলাদেশ সময়: ২০৪৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৫
এমআইকে/এইচআর/টিআই