মনোহরদী (নরসিংদী) থেকে: বাউন্ডারি নেই, কিন্তু ভবন বরাবর একটি লোহার গেট রয়েছে। যাতে ঝুলছে বড় একটি তালা।
গেটটি যে দীর্ঘদিন ধরেই তালাবদ্ধ রয়েছে তা তালার উপর জমে থাকা ধুলা-ময়লার প্রলেপ দেখে সহজেই অনুমান করা যায়।
মানুষের চলাচল ঠেকাতে বরই গাছের কাঁটা দিয়ে রাখা হয়েছে। পশ্চিম কোনে একটু ফাঁক রয়েছে, যে পথদিয়ে তিনজন স্টাফ যাতায়াত করেন। আর কর্তা আসেন কদাচিৎ। তিনিও ওই পথ দিয়েই যাতায়াত করেন।
মোবাইল ফোনের ধাক্কায় পরাজিত নরসিংদীর মনোহরদী ডিজিটাল টেলিফোন এক্সচেঞ্জ’র এই দশা।
লোহার গ্রিলের গেটের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিল ভবনের সামনে রোদে বসে একজন মাঝ বয়সী লোক পেপার পড়ছিলেন।
দ্বিতল ভবনটির গেট দিয়ে প্রবেশ দ্বারেই বারান্দায় পড়ে রয়েছে একটি কার্ডফোন বুথ। প্রথম কক্ষটিতে অব্যহৃত একটি কাঠের আলমারি ও লাইন মেরামতের কাজে ব্যবহৃত একটি স্টিলের মই রাখা হয়েছে।
ওই রুমের ভেতর দিয়ে গেলে পরের রুমটিতে একটি টেবিলকে ঘিরে রয়েছে ৩টি আধভাঙা চেয়ার। টেবিলের উপর রয়েছে দু’টি ফোন সেট। যার একটি সেই পুরনো আমলের, যাতে আঙ্গুলের সাহায্যে চাক্কা ঘুরিয়ে ডায়াল করতে হতো। ভেতরে জনশূন্য।
খানিকটা যাদুঘরের আবেশ ছড়িয়ে পড়ে মনের ভেতরে। মনকে সুদুর অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ক্ষণিকের জন্য। এই ফোনে কল করার জন্য লাইন ধরতে হতো। আর কত প্রহর গেছে সেই কাঙ্খিত ফোনের অপেক্ষার। আবার ফোন পেলেও কথা শেষ না করতে পারার কতশত স্মৃতি। আবার টেলিগ্রাম পাঠানোর মনকে স্মৃতিকাতর করে তোলে।
বাসায় সংযোগের জন্য ঘুষ দিয়েও জুতার তলা ক্ষয় করার সেই দুঃসহ স্মৃতি মানসপটে ভেসে ওঠে। কতদিনের কথা, এইতো সেদিনের কাহিনী। কিন্তু আজকে কি বেহাল দশা।
লোকজন আসেনা, এ কারণেই হয়তো গ্রিলের গেটটি আর খোলার প্রয়োজন পড়ে না। লোকজন আসেনা কারণে চেয়ার টেবিলগুলোও আর ঠিকমতো পরিষ্কার করা হয় না। তাই প্রলেপ পড়েছে ধুলার।
নানা রকম ভাবনা ভাবতে ভাবতে পাশের রুমে পা বাড়াই। আগে যে রুমটি আবাসিক প্রকৌশলীর কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কি ভাব ছিলো সেই কক্ষের ভারি পর্দা টানানো থাকত। তার সাক্ষাৎ পাওয়া ছিলো ভাগ্যের ব্যাপার।
কক্ষটি তালাবদ্ধ। সিঁড়ি দিয়ে দ্বিতীয় তলায় গেলে চোখে পড়বে সুইচ রুম। সেগুলোর জীর্ণ দশা, কতকাল যে কারো হাত পড়েনি অনুমান করা কঠিন। সব দরজা উন্মুক্ত।
ভবনের সবগুলো কক্ষ ঘুরে কোথাও কাউকে পাওয়া গেলো না। ভবন থেকে বেরিয়ে পত্রিকা নিয়ে মগ্ন থাকা ব্যক্তির দৃষ্টি আকর্ষণ করলে নিজেকে লাইনম্যান শাহাদত বলে পরিচয় দেন।
কয়জন স্টাফ রয়েছে এখানে? জানতে চাইলে বলেন, আর দু’জন লাইন ম্যান (রতন আলী হাওলাদার ও আমজাদ হোসেন) ও একজন ইঞ্জিনিয়ার (কামাল উদ্দিন আহমেদ) রয়েছে। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব শিবপুরে আছেন। কারণ তিনি একইসঙ্গে মনোহরদী ও শিবপুর অফিসের চার্জে আছেন। তাই ভাগাভাগি করে অফিস করেন।
শিবপুর এক্সচেঞ্জে ফোন দিলে সেখান থেকে ফিরতি বার্তা এলো তিনি নরসিংদী গেছেন। স্থানীয়রা জানালেন, মাসে দু’একদিন আসেন। কাজ নেই তদারকির নেই। তাই যাচ্ছে তাই অবস্থা। ভবনটির বেশির ভাগ জানালায় গ্লাস নেই। দেয়ালের রং উঠে গেছে অনেক আগে। কোথাও কোথাও প্লাস্টার খসে গেছে। ভবনের মতোই দিন দিন ভেঙ্গে পড়ছে এর গ্রাহক সংখ্যা।
আগে যেখানে পৌনে চার ‘শ গ্রাহক ছিলো, কমতে কমতে এখন একশোতে নেমে এসেছে। গ্রাহক বলতে গেলে সরকারি অফিস ভিত্তিক। মাত্র ৮টি সংযোগ রয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি মালিকের নামে।
২২ বছর ধরে এই এক্সচেঞ্জে চাকরি করছেন লাইনম্যান শাহাদত হোসেন। তিনি জানান, মোবাইল ফোন চলে আসার পর থেকেই জৌলুস হারাতে শুরু করেছে। এখন হাতে হাতে মোবাইল ফোন থাকায় কোনো লোক আর ফোন করতে আসে না।
টেবিলে থাকা পুরনো সেটটি অনেকদিন ধরেই বিকল। মাত্র একটি ফোন সেট সচল রয়েছে। যাতে অভিযোগ এলে মেরামত করার জন্য চলে যান।
তিনি বাংলানিউজকে জানান, এই ভবনে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ স্থানান্তর হয়েছে ১৯৯৩ সালে। ব্যবসা বৃদ্ধির জন্য ১৯৯৪ সালে চালু করা হয় কার্ড ফোনও। আবার এনালগ থেকে ১৯৯৬ সালে ১৭ আগস্ট ডিজিটালাইজড করা হয়। কিছুতেই যেনো যৌবন ফিরে পাচ্ছে না।
বরই কাঁটা দিয়ে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ প্রসঙ্গে শাহাদত হোসেন জানান, লোকজন এলোমেলো ভাবে মাঠ দিয়ে চলাচল করে তাই কাটা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। প্রায় সব ভবনের সীমানা প্রাচীর রয়েছে কিন্তু এখানে নেই।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৫
এসআই/এমইউএম/এসএইচ