রাজশাহী: ১৬ ডিসেম্বর পরাজয় বরণের পর মুক্তিকামী যৌথ বাহিনীর অগ্রগামী দল পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছ থেকে সাদা পাগড়ী ও আত্মসমর্পণের চিঠি বুঝে নেন। সেই চিঠি নিয়ে রাজশাহী শহরে বীরদর্পে প্রবেশ করেন।
তাদের চা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়, মহানগরীর সোনাদিঘীর মোড়ে সাংবাদিক মঞ্জুরুল হকের বাড়িতে। ওই সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হল, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারসহ বিভিন্ন বন্দিশালা থেকে নির্যাতিত মানুষ একে একে বেরিয়ে আসতে শুরু করেন স্বাধীন বাংলার মুক্ত বাতাসে।
সেই দিনটি ছিল ১৮ ডিসেম্বর। তাই বিশেষ এই দিনটি আজও স্মৃতিপটে আঁচড় কাটে রাজশাহীবাসীর। এ দিনটিই রাজশাহী মুক্ত দিবস। ৪৪ বছর আগে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর এসেছিল বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল বিজয়।
১৮ ডিসেম্বর মুক্ত হয় রাজশাহী। রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা মাঠে স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলেন লাল গোলা সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। পরে পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজশাহী ছেড়ে চলে যায় নাটোরে। আর তাদের দোসররা লুকিয়ে থাকে।
১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের সেই শুভক্ষণ এলেও রাজশাহীর মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ পায় ১৮ ডিসেম্বর। শহর শত্রুমুক্ত হয়। এ দিন থেকে নতুন দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে রাজশাহীর মানুষ। খাদ্য সংকট এড়াতে বিভিন্ন পাড়া মহল্লা থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর জন্য খাবার সরবরাহ করা হয়।
দীর্ঘ ৯ মাসের বিভীষিকাময় দুর্যোগের অবসান ঘটে। বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় আর আত্মপরিচয়ের ঠিকানা করে নেওয়ার অনুভূতিতে পুলোকিত হয়ে ওঠে রাজশাহীর মানুষ। মুক্তিকামী জনতার ঢল নামে রাজশাহী শহরের প্রতিটি সড়কে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন ৭নং সেক্টরের চার নম্বর সাব সেক্টর কমান্ডার সফিকুর রহমান রাজা বাংলানিউজকে জানান, রাজশাহীকে নেওয়া হয় ৭নং সেক্টরে। বিদেশি প্রতিনিধিদের পরিস্থিতি জানাতে মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্ত পার হয়ে আসেন। একাত্তরের ১৭ জুন ২৩ জন মুক্তিযোদ্ধা রাজশাহী শহরে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে শুরু করে তাদের অ্যাকশন অপারেশন। পাকিস্তানি সৈন্য ও দোসরদের নির্যাতন হত্যাযজ্ঞ বাড়তে থাকে।
রাজশাহীর নারীরাও অংশ নিলেন মুক্তিযুদ্ধে। কেউ সীমান্ত পার হয়ে ভূমিকা রাখলেন, কেউ এ পারেই হয়ে উঠলেন দুঃসাহসিক গেরিলা। ওই সময় আলবদর বাহিনী গঠনের পর শুরু হলো ত্রাস, হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, নির্যাতনসহ নানা নিপীড়ন। পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বধ্যভূমিতে হত্যা করে চার হাজার মানুষকে। নিরীহ নারীরাও পাকিসেনাদের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাননি।
রাজশাহীর বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা নূর হামীম রিজভী বীরপ্রতীক বাংলানিউজকে জানান, পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের দোসরদের মদদে বিভিন্ন কায়দায় মানুষ হত্যা করে রাজশাহীর পদ্মা নদীতে ফেলে দেয়।
এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা ঢুকে পড়তে থাকে রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চলে। ২৫ নভেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজশাহী মহানগরীর শ্রীরামপুর বাবলাবন চরে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জীবন্ত অবস্থায় বালির মধ্যে পুঁতে হত্যা করে। সবকিছু সহ্য করে স্বাধীনতার দিনগুণতে থাকে রাজশাহীর মানুষ।
মিত্র বাহিনীর বিমানকে স্বাগত জানাতে সবাই তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। সে সময় পাকিসেনাদের বিমান বোমা ফেলতে থাকে রাজশাহীতে। মহদিপুর সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর রাজশাহী অ্যাডভান্সের পরিকল্পনা নিলেন। তিনি ১৪ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জের রেহায় চরে শহীদ হন। পরে মুক্তিযোদ্ধা-মিত্রবাহিনী রাজশাহীর দিকে দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়।
লালগোলা সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ও সেখপাড়া সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর রশিদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিসেনাদের সঙ্গে লড়াই করে মুক্ত করে রাজশাহীর গ্রামাঞ্চল। ১৬ ডিসেম্বর অত্মসমর্পণের চিঠি নিয়ে ১৮ ডিসেম্বর তারা রাজশাহী প্রবেশ করেন।
বাংলাদেশ সময়: ২০৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৫
এসএস/পিসি