ঢাকা: আয়তন অনুপাতে রাজধানী ঢাকা ৫০ থেকে ৬০ লাখ মানুষের বসবাসের উপযোগী। কিন্তু এখানকার জনসংখ্যা দুই কোটির মতো।
নগর বিশেষজ্ঞদের গবেষণা আর বিভিন্ন সংস্থার পরিসখ্যানে উঠে আসা এ তথ্য শুধু অংকের হিসেবেই নয়। নগরবাসীও প্রতিমুহূর্তে এসব তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন।
দেশের রাস্তাঘাট নিয়ে যে মন্ত্রণালয় সেই একই মন্ত্রণালয় পরিবহনেরও দায়িত্বপ্রাপ্ত। সে মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজেও এ তিন সমস্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
তিনিও বলছেন, সড়কে যেমন অসহনীয় যানজট আছে তেমটি জনজট হচ্ছে আবার জলজটও হচ্ছে।
তার মন্ত্রণালয়ের অধীন সড়ক ও জনপথ বিভাগের গবেষণায় দেখা গেছে, যানজটে বছরে ক্ষতির পরিমাণ ২০ হাজার ৮০ কোটি টাকা।
যাত্রী জ্বালানি, পরিবেশ আর স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি তাদের গবেষণায় দেখিয়েছে, বছরে ক্ষতির পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা।
যানজটের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে সবশেষ তথ্য দিয়েছে বিনিয়োগ বোর্ড। সদ্য বের করা তাদের হিসেবে দেখা গেছে, যানজটের কারণে বছরে অর্থনৈতিক ক্ষতি দাঁড়াচ্ছে ১ লাখ কোটি টাকা।
তবে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী চেয়ে আছেন ২০১৮-১৯ সালের দিকে। তখন মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) বাস্তবায়িত হলে যানজট নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে মনে করছেন তিনি।
আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক হাতিরঝিল মোড় থেকে গাজীপুর পর্যন্ত ২২টি ইউ-লুপ বাস্তবায়ন করে ৩০ শতাংশ যানজট নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন। মাস দু’য়েকের মধ্যে এর কাজ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
এদিকে বর্ষা মৌসুমসহ বছরের বেশিরভাগ সময় সামান্য বৃষ্টিতেই রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। অলি-গলি থেকে শুরু করে জলমগ্ন থাকে রাজধানীর রাজপথও। এতে শুধু যে চলাচলে ভোগান্তি হয় তা নয়, অনেক এলাকার বাসা-বাড়িতেও পানি উঠে বসবাস হয়ে ওঠে দুর্ভোগময়।
বিশ্বব্যাংকের এক সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদনে বছরে এ ক্ষতির পরিমাণ গড়ে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।
তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরে যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়, তা নিরসনের কোনো উদ্যোগ না নিলে ২০১৪ থেকে ২০৫০ সাল পর্যন্ত সময়ে ১১ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির শিকার হবে ঢাকা। আর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যুক্ত হলে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে দিক-নির্দেশনায় বলা হয়েছে, জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য সরকার যদি এখনই পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নত করা, খাল ও জলাশয়গুলো দখলমুক্ত করে পানি চলাচলের ব্যবস্থা করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়, তাহলে ক্ষতির পরিমাণ ৭ হাজার কোটি টাকা কমানো সম্ভব। এসব কাজে ব্যয় হবে ২৭০ কোটি টাকা।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বাংলানিউজকে বলেন, জলাবদ্ধতার কারণ হলো, আমরা ঢাকার খালগুলো ভরিয়ে দিয়েছি। সেগুলো বেশিরভাগই বেদখল আর অবৈধ স্থাপনার নিচে। খালগুলো উদ্ধার করে যদি চালু করা যায় তাহলে সড়কপথের যানজট কমে আসবে। অপরদিকে শহরের রাস্তাও জলে ডুববে না।
জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের নগর গবেষণার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নত ও সমৃদ্ধ নগরের ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ রাস্তা থাকলেও ঢাকায় আছে মাত্র ৬ থেকে ৮ শতাংশ রাস্তা।
প্রতিদিন জীবন- জীবিকার তাগিদে ঢাকায় প্রবেশ করছেন প্রায় ৩ হাজার মানুষ। আর প্রতি বছর ঢাকায় বাড়ছে ৭ থেকে ৮ লাখ লোক। বাড়ি-ঘরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গাড়িও।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, রাজধানীতে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ১০ লাখ বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক যানবাহনের নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রাইভেটকারের সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। যেখানে ২০০৯ সালে এ সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৪৩ হাজার ৩৮৯টি। শেষ সাড়ে ৪ বছরে প্রাইভেটকার নিবন্ধনের হার ছিল বছরে গড়ে ১৫ হাজার ৯১০টি।
২০১০ সালে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে ১৯ হাজার ৬১৫টি, ২০১১ সালে ১১ হাজার ৪২৩টি, ২০১২ সালে ৮ হাজার ১৮৭টি, ২০১৩ সালে ৯ হাজার ২৩১টি, ২০১৪ সালে ১২ হাজার ৯৭২টি ও ২০১৫ সালের জুলাই পর্যন্ত মোট ১০ হাজার ১৭০টি প্রাইভেটকারের নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীতে নিবন্ধিত জিপের সংখ্যা ২৬ হাজার ৭৫৩টি ও মাইক্রোবাসের সংখ্যা ৬০ হাজার ৭৯৪টি, যা গণপরিবহনের পর্যায়ে পড়ে না। অন্যদিকে নিবন্ধিত গণপরিবহনের মধ্যে বাস রয়েছে ২৩ হাজার ২৯টি ও মিনিবাস রয়েছে ৯ হাজার ৯৯৯টি।
পরিবেশবাদী ১৩টি সংগঠন জানিয়েছে, ঢাকা শহরের যানজটের অন্যতম কারণ প্রাইভেটকার। অথচ প্রতিদিন শতাধিক নতুন কারের নিবন্ধন দেওয়া হচ্ছে।
তাই যানজট নিরসনে প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক নীতিমালা দাবি তুলে এসব সংগঠন।
বিআরটিএ’র সচিব শওকত আলী বাংলানিউজকে জানান, প্রাইভেটকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নতুন একটি প্রস্তাবনার খসড়া তৈরি করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলেই প্রাইভেটকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন তারা।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, প্রাইভেটকার নিয়ে তারা একটি সিদ্ধান্তে যাবেন। তবে ঢাকার যানজটের সঙ্গে জনজটও বেশি। ফুটপাত জনগণের। কিন্তু সেই ফুটপাত অন্যরা ব্যবহার করছে- এর পেছনে রাজনৈতিক মদদ আছে।
মন্ত্রী বলেন, সংশোধিত এসটিপি বাস্তবায়িত হলে ঢাকার যানজট সহনীয় পর্যায়ে যাবে। সরকার সে লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করছে। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজও শুরু হয়েছে।
২০১৮-১৯ সালে যানজট নিয়ন্ত্রণের জন্য এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হলে সড়ক পরিবহন ও যোগযোগে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে বলেও মনে করেন সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বাংলানিউজকে বলেন, পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের কলকাতা নগর ব্যবস্থায় বিকেন্দ্রিকরণসহ শহরের জনসংখ্যার চাপ কমাতে নানা পদ্ধতি অবলম্বন করে। এছাড়া পাতালরেল, ওভার ও আন্ডারপাস তৈরির মাধ্যমে যানজটও নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। কলকাতার সেই ফর্মুলা ঢাকার ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যেতে পারে।
তবে এসব পরিকল্পনার সুফল নিয়ে নগর বিশেষজ্ঞদের কারো কারো প্রশ্ন আছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মুসলেহ উদ্দিন হাসান বাংলানিউজকে বলেন, সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (আরএসটিপি) দেখা গেছে, মেট্রোরেল এবং বাস র্যাপিড ট্রানজিট বাস্তবায়িত হওয়ার পরও সেগুলো মাত্র ৬০ শতাংশ যাত্রী বহন করবে। বাকি ৪০ শতাংশের কি হবে?
তবে দ্রুত গন্তব্যে যেতে হলে সবচেয়ে ভালো পরিবহন ব্যবস্থা হবে মেট্রোরেল এবং বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি)।
বুয়েটের এই নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, আমাদের এখনই গুরুত্ব দিতে হবে সেসব গণপরিবহন ব্যবস্থার দিকে যেগুলো কম খরচে বেশি যাত্রী বহনে সক্ষম।
আর মূল সড়কে আসার জন্য ছোট বাহনের ব্যবস্থা থাকতে হবে, না হলে কোনো লাভ হবে না।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, হাতিরঝিলে নৌ-রুট চালু করা যেতে পারে। কিন্তু রামপুরায় নেমে অথবা সাতরাস্তার মোড়ে নেমে পড়ে যাত্রী কিভাবে যাবেন?
আর যেসব এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ মার্কেট স্থাপনা নির্মাণ করা হবে, তখনই এটা মাথায় নিতে হবে যে, যানজট সেখানে কতোটা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৫
এসএ/এএসআর