ঢাকা: মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত কিশোরগঞ্জের শামসুদ্দিনসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের দুই সাক্ষী মো. চান্দু মিয়া এবং আব্দুল মান্নান। তাদের দু’জনের বাড়িই কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলায়।
একই মামলার ওই পাঁচ আসামির মধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন অ্যাডভোকেট শামসুদ্দিন আহমেদ। পলাতক চারজন হচ্ছেন শামসুদ্দিনের সহোদর সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন মো. নাসিরউদ্দিন আহমেদ এবং রাজাকার কমান্ডার গাজী আব্দুল মান্নান, হাফিজ উদ্দিন ও আজহারুল ইসলাম।
আসামিদের বিরুদ্ধে সাতটি অভিযোগের মধ্যে ৬নং অভিযোগে সাক্ষ্য দিয়েছেন সাক্ষীরা। রাষ্ট্রপক্ষের ১৯তম সাক্ষী চান্দু মিয়া শহীদ আবু বক্কর সিদ্দিকের ছোট ভাই এবং ২০তম সাক্ষী আব্দুল মান্নান শহীদ রুপালীর ভাতিজা।
রোববার (২০ ডিসেম্বর) বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষ্য দেন সাক্ষীরা। সাক্ষ্যগ্রহণে ট্রাইব্যুনালকে সহযোগিতা করেন প্রসিকিউটর রেজিয়া সুলতানা চমন। প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম ও জাহিদ ইমাম ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তেন উল্লেখ করে চান্দু মিয়া তার সাক্ষ্যে বলেন, ১৯৭০ সালে তার বড় ভাই আবু বক্কর সিদ্দিক আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে যান এবং প্রশিক্ষণ শেষে একই বছরের ভাদ্র মাসের প্রথম সপ্তাহে বাড়ি ফিরে আসেন।
চান্দু মিয়া বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৫ আগস্ট আবু বক্কর সিদ্দিক, কাজী রুহুল আমিনসহ একই গ্রামের মাইজ পাড়ার হামিদের বাড়িতে ছিলাম। সূর্য ওঠার সময় আমি বাড়ির গোয়াল থেকে গরু বের করার সময় ভাইয়ের (আবু বক্কর সিদ্দিক) চিৎকার শুনতে পাই’।
‘আমি ওই গোয়ালে লুকিয়ে থেকে দেখতে পাই, আসামি শামসুদ্দিন আহমেদ, গাজী মো. আব্দুল মান্নান, এটিএম নাসির, মো. হাফিজ উদ্দিন ও মো. আজহারুল ইসলামসহ ৭/৮ জন রাজাকার আমার ভাই আবু বক্কর সিদ্দিককে ধরে উত্তর দিকে কাজী রুহুল আমিনের বাড়িতে নিয়ে কাঁঠাল গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলেন’।
কাজী রুহুল আমিনের চাচা আহম্মেদের বাড়ির রান্নাঘরে লুকিয়ে থেকে সাক্ষী আরও দেখতে পান, কয়েকজন রাজাকার পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে রুপালীকে ধরে এনে একই কাঁঠাল গাছের সঙ্গে বাঁধেন। এ সময় রাজাকাররা রুহুল আমিনের বাড়িতে লুটপাট চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে আবু বক্কর সিদ্দিক এবং রুপালীকে নিয়ে চলে যান।
সাক্ষ্যে এ ঘটনার বর্ণনা করার সময় অঝোরে কাঁদতে থাকেন সাক্ষী চান্দু মিয়া।
সাক্ষী আরও বলেন, ভাই আবু বক্কর সিদ্দিককে ছাড়িয়ে আনতে গেলে তার পরিবারের কাছে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণও দাবি করা হয়। পারিবারের পক্ষ থেকে ৩৬ হাজার টাকা জোগাড় করে মোলাম খা চরের সুরুজ মৌলভীকে দেওয়া হয়। কিন্তু তারপরও ভাই আবু বক্কর সিদ্দিককে আর ফিরে পাননি তারা। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তার আর কোনো সন্ধান মেলেনি বলে সাক্ষ্যে উল্লেখ করেন তিনি।
সাক্ষী বলেন, ‘আমার মা ভাইয়ের শোকে অন্ধ হয়ে মারা যান। আমি এর বিচার চাই’।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আনুমানিক বয়স ছিল ১২ বছর উল্লেখ করে অপর সাক্ষী আব্দুল মান্নান তার সাক্ষ্যে একই ঘটনার বর্ণনা দেন। চাচা রুপালীকে ধরে নেওয়ার সময় তিনি বাড়ির পাশের ক্ষেতে কাজ করছিলেন।
রুহুল আমিনের বাড়ির পাশের একটি ঝোঁপ থেকে সমস্ত ঘটনা দেখেন বলে সাক্ষ্যে উল্লেখ করেন সাক্ষী আব্দুল মান্নান।
এ সময় আসামি শামসুদ্দিন আহমেদ ট্রাইব্যুনালে আসামির কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। সাক্ষ্য শেষে সাক্ষীদের জেরা করেন রাষ্ট্র নিয়োজিত আসামিপক্ষের আইনজীবী আব্দুশ শুকুর খান এবং আসামি শামসুদ্দিন আহমেদের আইনজীবী মাসুদ রানা।
জেরা শেষ হলে ট্রাইব্যুনাল পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য সোমবার (২১ ডিসেম্বর) দিন ধার্য করেন।
গত ১২ অক্টোবর মানবতাবিরোধী অপরাধে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের ওই পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। গত ১৩ মে তাদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেন।
আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, আটক, লুণ্ঠন, নির্যাতনসহ সাতটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। আসামিরা কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ থানার বিদ্যানগর, আয়লা, ফতেরগুপ বিল, পীরাতন বিল ও আশেপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এসব মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ মামলায় ৪০ জনকে সাক্ষী করেছেন প্রসিকিউশন।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৫
এমএইচপি/এএসআর