জাফলং (সিলেট) থেকে: নতুন রাস্তা তৈরি করার জন্য মাটি ফেলে রাখলে যেমন দেখায়, ঠিক তেমনি অবস্থা সিলেট-জাফলং সড়কের।
মহাসড়ক না-কি চাষের জমি, সেটা আলাদা করার জো’ নেই।
জায়গায় জায়গায় বিশাল বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে বৃষ্টি হলেই এ পথ মাড়ান না সিএনজি চালিত অটোরিকশা, লেগুনা ও ট্যাক্সি চালকরা। তখন একমাত্র ভরসা মুড়ির টিনের মতো বাসগুলো। কিন্তু বাসের দুলুনি দেখলে কলিজা শুকিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।
ভয়ঙ্কর দুলুনি অনেকের হৃদপিণ্ডে কাঁপুনিও ধরিয়ে দেয়। যে কারণে কেউ একবার গেলে এ পথ মাড়াতে দ্বিতীয়বার আর সাহস দেখান না।
সিলেট শহর থেকে ৬৩ কিলোমিটারের এ পথটি পাড়ি দিতে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। পর্যটকরা আগে সকালে গিয়ে সারাদিন ঘুরে সন্ধ্যায় ফিরে সিলেট রাতযাপন করতেন। এখন যেতে-আসতেই সময় চলে যাচ্ছে।
সিলেট থেকে দস্তরবন্দ পর্যন্ত রাস্তার অবস্থা অনেকটা স্বাভাবিক। দস্তরবন্দ থেকে দুর্ভোগের শুরু। দস্তরবন্দ এলাকায় পিচগুলো ঢেউয়ের মতো উঁচু হয়ে এক-তৃতীয়াংশ রাস্তাকে আলাদা করে ফেলেছে। যে কারণে হরহামেশাই বিভ্রান্ত হচ্ছেন চালকরা। ঘটছে দুর্ঘটনা। যার অনেকগুলোই থাকছে অজানা।
এরপর বাংলাবাজার, শ্রীপুর চাবাগান, আলুবাগান, নলজুরি, সারিঘাট, জৈয়ন্তাপুর বাজার, চাংগিল বাজার, চার নম্বর বাজার, আসামপাড়া ও আদর্শ গুচ্ছগ্রাম। এখানে রাস্তার নাম-নিশানা পর্যন্ত নেই।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অবস্থা তামাবিল সড়কের। এখানে বোঝার উপায় নেই যে, রাস্তা নাকি চাষের জমি দিয়ে গাড়ি চলছে। এখানে বৃষ্টিতে যেমন দুর্ভোগ তেমনি ধুলোতেও নাকাল পর্যটকরা। সিএনজি চালিত অটোরিকশা কিংবা লেগুনার যাত্রীদের ভ্রমণের আনন্দ ধুলোর আবরণে ফিঁকে হয়ে যাচ্ছে।
পাথর, কয়লা ও বালু বোঝাই ট্রাকের বহরের ধুলায় একাকার হয়ে যাচ্ছে পর্যটকদের শরীর। ভাঙা রাস্তার কারণে যেমন সময় নষ্ট হচ্ছে, পাশাপাশি খরচও বেড়ে গেছে অনেকখানি। আগে ৫শ’ টাকায় সিএনজি চালিত অটোরিকশা ভাড়া পাওয়া যেতো। এখন সেখানে যেতে ৭শ’ থেকে ৮শ’ ভাড়া হাঁকছেন চালকরা।
অটোরিকশা চালক মুক্তার হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, আগে এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগতো। আর এখন দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। ট্রাকের বহর যখন ছাড়ে, তখন এক সাইডে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। স্বাভাবিক কারণেই ভাড়া বেশি নিতে হচ্ছে।
সিলেট-জাফলং রুটে চলাচলকারী বাসের (বিরতি পরিবহন) চালক বেলাল আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘দুই বছর ধরে রাস্তাটির এ অবস্থা। যেভাবে বাস দোল খায়, তাতে আমারই ভয় লাগে। মনে হয়, এই বুঝি উল্টে যাবে’।
এ রুটের বাসগুলো নিয়ে পর্যটকদের অভিযোগের ইয়ত্তাও নেই। দাঁড়ানোর কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। সর্বত্রই যেন স্ট্যান্ড, লোক দেখলেই দাঁড়িয়ে পড়ছে।
জাফলং ঘুরতে আসা সুলতান মাহমুদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘অনেক রুটে চলেছি। কিন্তু এ রুটের বাসগুলোর মতো উদার বাস দেখিনি। কোনো যাত্রীকে তারা ছেড়ে যায় না’।
‘জাফলংয়ের পর্যটন বিকাশের জন্য সরাসরি বাস সার্ভিস থাকা উচিত। সবচেয়ে ভালো হয় বিআরটিসি বাস ছাড়তে পারলে’ বলেও মন্তব্য করেন সুলতান মাহমুদ।
২০১৪ সাল গেছে নির্বাচন ঠেকানোর সহিংসতায়। আর ২০১৫ সালে টানা ৯৩ দিনের হরতাল-অবরোধে পর্যটকখরা ছিল জাফলংয়ে। এবার রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকায় আশাবাদী করে তুলেছে সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু রাস্তা পর্যটকদের বিমুখ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
জিরো পয়েন্টের ঝালমুড়ি বিক্রেতা আমিনুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘দুই বছর খুব খারাপ অবস্থা গেছে। এবার একটু করে জমতে শুরু করেছে। কিন্তু রাস্তার এ অবস্থার খবর পেয়ে অনেকে আর জাফলং আসতে চাচ্ছেন না’।
রাস্তাটির এ অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার কারণ খুঁজতে বেশিদূর যেতে হলো না। সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালক জানালেন, ট্রাকগুলোতে ৫ টন বোঝাই পাথর নেওয়ার কথা। কিন্তু তারা পঁচিশ থেকে পঁয়ত্রিশ টন পাথর বোঝাই করে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। এ রাস্তা টিকবে কেমন করে?
জাফলংয়ে এর আগে গিয়েছিলাম পনের বছর আগে। এবার গিয়ে আগের অবস্থার সঙ্গে মেলাতে বেশ কষ্ট হলো। আগে যেখানে বিশাল নদী ছিল, এখন সেখানে সামান্য পানির ধারা। আগে নৌকা দিয়ে নদী পার হয়ে সংগ্রামপুঞ্জি মন্দির ও কমলা বাগানে যেতে হয়েছিল। এবার সেখানে হাঁটু পানি মাড়িয়ে পার হওয়া যায়।
জাফলংয়ের সত্যিকার জিরো পয়েন্টও এখন পায়ের নাগালে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯১২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৫
এসআই/এএসআর