ঢাকা: এদের কারোরই কোনো ঘর-সংসার নেই। এমনকি একটি বা দু’টি কাপড়ের বেশি জামাকাপড়ও নেই।
তবে তা নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই ওদের। সারাদিনের খাবার সংগ্রহ শেষে গাঁজা খাওয়ার টাকা হলেই চলে যায় ওদের বেশিরভাগ লোকের। আর যাদের নেশার প্রয়োজন বেশি তাদের বোতল, কাগজ লোহা, প্লাস্টিক টোকানোর পাশাপাশি ঝুঁকি নিয়ে চুরির মতো কাজও করতে হয়।
২৩ বছর বয়সী মোহাম্মদ মমিনের মতো প্রায় বিশজন লোকের একই অবস্থা দেখা গেছে। এদের মধ্যে ২২ থেকে ৪৫ পর্যন্ত বয়সের মানুষ রয়েছে। এরা একে অন্যের পাশাপাশি ফুটপাতে কোনো বিছানা কম্বল ছাড়াই শুয়ে আছেন।
এদের অনেকেই শুধু বেঁচে থাকার চেষ্টায় দু’বেলা খাবারের জন্য রাজধানীর ফার্মগেট-কারওয়ান বাজারের ফুটপাতে এভাবেই পড়ে আছেন বছরের পর বছর। এক দম্পতিও রয়েছেন এই তলিকায়। নোয়াখালীর রহমতুল্লাহ এবং স্ত্রী ছমিরন এই ফুটপাতেই কাটিয়ে দিচ্ছেন কয়েক বছর ধরে।
গাজীপুরের কাপাশিয়ার এলাকার টোকাই মোহাম্মদ মমিন জানান, ফুটপাতের এসব লোকদের বেশিরভাগের বয়স ২২ বছরের বেশি। তবে কম বয়সীরাও জীবন চালাচ্ছে একই কাজ করে। এদের সবাই কম বেশি গাঁজায় আসক্ত। কারো কারো শুধু গাঁজাতে হয়না, প্রয়োজন হয় সীসা ও ড্যান্ডি মতো নেশার। আবার কেউ কেউ হেরোইনের নেশাতেও আসক্ত।
রাজধানীর ফার্মগেটে থেকে কারওয়ান বাজার যেতে রাস্তা পারাপারের জন্য ফুটওভার ব্রিজের পূর্বপাশে ফুটপাতেই এদের রাতের সংসার। দিনে এরা বোতল, কাগজ, লোহা, প্লাস্টিক টোকায়। আবার কেউ কেউ গাড়ির চাকা ফুটো হয়ে গেলে কিংবা ইঞ্জিন বিকল হলে তা ঠেলে দিয়ে টাকা উপার্জন করেন।
সকালে নাস্তা আর দিনে আরো এক বেলা খাবার হলেই কোনো রকমে দিন পার করে নেয় এরা। তবে নেশার জন্য বরাদ্দ রেখেই খাবারের জন্য বাকি অর্থ খরচ করে। দিনভর রাজপথ, গলি পথ, ফুটপথ, ডাস্টবিন মাড়িয়ে পার হয়ে যায় দিন। রাতে ফুটপাতের পাশে তাদের আশ্রয়স্থল।
ফুটওভার ব্রিজ থেকে কারওয়ান বাজেরর দিকের ফুটপাত ও রাস্তায় কিশোর থেকে যুবক পর্যযন্ত বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ রাতে ঘোরাঘুরি করে শুধু চুরি করার জন্য। ওরা পেশাদার চোর বলেই দাবি মমিনের মতো আরো কয়েকজনের। মমিন বলেন, আমরা বোতল টোকাই, ওরা চুরি করে। ওরা ওদিকেই (কাওরান বাজারের দিকে) থাকে। আমরা এপাশেই থাকি। এপাশে ওরা আসে না। আমরাও যাই না ওপাশে।
মমিন জানান, এপাশে টোকাইরা যখন ঘুমায়, তখন কারওয়ান বাজারের কাছাকাছি চোরেরা রাতভর ঘুরাঘুরি করে, চুরি করার অপেক্ষায়। সুযোগ পেলেই ওরা চুরি করে পালায়। আবার ফিরে আসে চুরি করার জন্য। আমরা দিনে বোতল-কাগজ টোকাই আর রাতে রাস্তায় ঘুমাই। আর ওরা দিনে ঘুমায় আর রাত জেগে চুরি করে।
নোয়াখালীর দিন মজুর রহমতুল্লাহ জানান, আজ বেশি শীত তাই নিজে বসে রয়েছেন কাপড় কম্বলের অভাবে। একটি পুরাতন কম্বল রয়েছে, তা জড়িয়েই স্ত্রী শুয়ে আছেন। স্ত্রী কোনো কাজ করে কিনা জানতে চাইলে বলেন, ও বোতল টোকায়। দু’জনে মিলে যা আয় করি, তার মধ্যে কিছু টাকা বাড়িতে একটি মেয়ে রয়েছে তার জন্য পাঠাতে হয়।
মো. হৃদয় নামের ময়মনসিংহের এক যুবক জানালেন, স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি তাই ফুটপাতেই এভাবে চালিয়ে নিচ্ছি। গাঁজায় প্রতিদিন তার ৩০ থেকে ৪০ টাকা লাগে। এ খরচ রেখেই বাকি টাকা দিয়ে খাবার খরচ চলে।
রাতে যারা এই এলাকায় রয়েছেন তাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলেই জানা গেলো, সংসারে অস্বচ্ছলতার কারণে কাজের খোঁজে ঢাকায় এসে প্রথমে ফুটপাতে দাঁড়াতে হয়েছে। দিনের পর দিন কাজ না পেয়ে না খেয়েও কাটাতে হয়েছে। এভাবেই থাকতে থাকতেই বেশিরভাগ লোকই নেশায় ডুবেছে, যেনো দেখার কেউ নেই।
মমিনসহ এই অভাবী মানুষগুলোর অনেকেই জানতে চেয়েছেন এবার বেশি শীত, কম্বল কিংবা কাপড় দেবে কি না সরকার। আরতো কিছু চেয়ে পাওয়া যাবে না, এমন মন্তব্য বেশিরভাগ ছিন্নমূল মানুষের।
বাংলাদেশ সময় : ০৭১৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১৫
এসএমএ/এসএইচ