ঢাকা, বুধবার, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

আবু তাহের হত্যার চার্জশিট

চাকরিচ্যুতির ক্ষোভে খুন করেন ব্যক্তিগত গাড়িচালকসহ দশজন

শেখ জাহাঙ্গীর আলম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০১৬
চাকরিচ্যুতির ক্ষোভে খুন করেন ব্যক্তিগত গাড়িচালকসহ দশজন ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: চাকরিচ্যুত ব্যক্তিগত গাড়িচালকের আক্রোশ থেকেই খুন হন সাবেক কর (ট্যাক্স) কমিশনার আবু তাহের। আর এ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন তার ব্যক্তিগত ওই গাড়িচালকসহ বাসার দুই গৃহকর্মী।



এ ঘটনায় ১০ জনকে আসামি করে চলতি বছরের গত ০৬ জানুয়ারি (বুধবার) ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।

অভিযুক্তরা হলেন, নিহতের গাড়িচালক মো. নাসির, রাসেল, রুস্তম, সোহেল, আমির হোসেন, মাসুদ, সুজন, নুর আলম এবং দুই গৃহকর্মী নুরজাহান ও সেলিনা।

মামলার সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঘটনার পর প্রায় ১০ মাসের তদন্তে হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারীসহ অভিযুক্তদের শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। তবে তাদের মধ্যে একজন আসামি এখনও পলাতক রয়েছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সিনিয়র সহকারি পুলিশ কমিশনার মো. ইকবাল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, চাকরিচ্যুত করার ক্ষোভেই পরিকল্পিত ভাবে এ হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছেন নিহতের গাড়িচালক মো. নাসির। আর হত্যা পরিকল্পনার সহায়তায় ছিলেন নিহতের দুই গৃহকর্মী।

তিনি বলেন, হত্যার ঘটনায় ওই বাড়ির সকলের মোবাইল কললিস্ট ও কল ডিটেল রেকর্ড (সিডিআর) ধরে গোয়েন্দা পুলিশ অনুসন্ধান করলে নাসিরসহ সবাইকে গ্রেফতার করা হয়।

এ মামলায় অভিযুক্ত ১০ জনের মধ্যে ৯ জন আসামিকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে আটজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন বলেও জানান তিনি। বাকি একজন পলাতক রয়েছেন।    

গত বছরের ০১ মার্চ পূর্ব রামপুরা এলাকার টিভি রোডের ৩৪৭ নম্বর নিজ বাসায় খুন হন মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের (৭০)। তিনি ইনকাম ট্যাক্সের সাবেক কর কমিশনার ছিলেন। হত্যার পর খুনিরা ওই বাসা থেকে নগদ ৪৫ হাজার টাকা ও ১০/১২ ভরি স্বর্ণ ও তিনটি মোবাইল ফোন লুট করে নিয়ে যান।

ঘটনার পরদিন নিহতের ছোট ছেলে এটিএম আরিফুল হক বাদী হয়ে রামপুরা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।

তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হত্যার পরিকল্পনাকারী নাসির ছিলেন আবু তাহেরের ব্যক্তিগত গাড়িচালক। কাজ-কর্মে মনযোগী না থাকায় তাকে গত বছরের ২১ জানুয়ারি চাকরিচ্যুত করেন আবু তাহের। পরে ওই মাসের ১০ দিন বাকি থাকলেও পুরো বেতন দিয়ে দেন তিনি। চাকরি থেকে বাদ দেওয়ার কারণে ওইদিনই চালক নাসির আবু তাহেরকে প্রাণনাশের হুমকি দেন।   

এ বিষয়ে ২০১৫ সালের ২২ জানুয়ারী রামপুরা থানায় নাসিরের বিরুদ্ধে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন কর কমিশনার আবু তাহের।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই)শরীফ রফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত করতে সেখানে ১০ জন উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে মূল পারকল্পনাকারী নাসির ও তার কথিত খালাতো ভাই রাসেল এবং ওই বাড়ির দুই গৃহকর্মী নুরজাহান ও সেলিনাসহ আরো ৬ জন একত্রিত হয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটায়।

এক মাস আগে থেকেই ওই বাসায় ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করছিলেন নাসির। পুরো দলটি তিন ভাগে বিভক্ত ছিলো। এর মধ্যে গৃহকর্মী নুরজাহান ও সেলিনা বাড়ির সব তথ্য সরবরাহের দায়িত্বে ছিলেন। বাড়ির বাইরে পাহারা ও সরঞ্জাম আনার দায়িত্বে ছিলেন সুজন, মাসুদ ও নুর আলম এবং মূল অপারেশনে ছিলেন নাসির, রাসেল, রুস্তম, সোহেল ও আমির হোসেন।

তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, হত্যাকাণ্ডের আগে থেকেই ওই বাসায় কিভাবে প্রবেশ করা যাবে তার ছক আঁকেন আসামিরা। গৃহকর্মী সেলিনার সহায়তায় ওই বাড়ির মূল গেটের একটি চাবি তৈরি করেন নাসির।

তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানান, ০১ মার্চ সন্ধ্যায় অভিযুক্তরা সবাই মেরাদিয়া এলাকার বালুর মাঠে সাক্ষাত করেন। ডাকাতি ও খুনের পরিকল্পনায় কার কি ভূমিকা ও কাজ সেগুলো সবাইকে বুঝিয়ে দেন নাসির।

পরিকল্পনা অনুযায়ী মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বাড়ির পরিস্থিতি জানান গৃহকর্মীরা।

রাত ১২টায় ওই বাড়ির সীমানা প্রাচীরের ভেতরে প্রবেশ করেন সবাই। চারদিক নীরব হলে রাত ৩টায় বাড়ির মূল গেট দিয়ে প্রবেশ করেন নাসির, রাসেল, আমির, রুস্তম ও সোহেল। বাসার দ্বিতীয় তলার গেট খুলতে নুরজাহানকে ফোনে জানানো হয়। কিন্তু ওই গেটের চাবি নুরজাহানের কাছে না থাকায় গেট খুলতে পারেননি তিনি। পরে দ্বিতীয় তলার জানালার গ্রিল ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করেন ৫ জন।

গৃহকর্মীদের সহায়তায় তাদের ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে আবু তাহেরের স্ত্রী রেবেকাকে কসটেপ দিয়ে মুখ, হাত-পা বেধে ফেলেন তারা।

খাটে শুয়ে থাকা আবু তাহেরের বুকের ওপর উঠে বসে রুস্তম ও নাসির গলা চাপ দিয়ে ধরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। এরপর মৃত্যু নিশ্চিতের জন্য নিহতের ডান হাত ও পায়ের রগ কাটেন এবং গলায় ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করেন।

হত্যার পর পুরো বাসা তল্লাশি করে নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার ও মোবাইল সেট লুট করে ভোর ৫টায় ওই বাড়ি থেকে পালিয়ে যান তারা।

সকালে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে গৃহকর্মী দু’জন পুরো ঘটনাটি ডাকাতি বলে এড়িয়ে যান বলেও জানান মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তারা।

নিহতের ছোট ছেলে এটিএম আরিফুল হক বাংলানিউজকে বলেন, ‘নিজেদের ঘরের ভেতরেই ডাকাতের উপস্থিতি ছিলো। হত্যাকারীরা ঠাণ্ডা মাথায় আমার বাবাকে খুন করেছেন। আমরা এর সঠিক বিচারের দাবি করছি’।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৯, ২০১৬
এসজেএ/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।