ঢাকা, রবিবার, ৪ মাঘ ১৪৩১, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন কাণ্ড- ১

বঙ্গবন্ধু পরিবারের নাম ভাঙিয়ে সরকারি জমি দখল

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৬
বঙ্গবন্ধু পরিবারের নাম ভাঙিয়ে সরকারি জমি দখল

নারায়ণগঞ্জ: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের নাম ব্যবহার করে সরকারি জমি দখলের চেষ্টা এবং বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে সমালোচনার মুখে ঠেলে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।

বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

তাদের অভিযোগ, শেষ মুহূর্তে আখের গোছাতে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার টেন্ডার দিয়ে নিজের আস্থাভাজন ও বহুল সমালোচিত একজন ঠিকাদারের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাটের অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছেন মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও রেল মন্ত্রণালয়ের বিশাল দুটি সম্পত্তি গিলে খেতে তাই বঙ্গবন্ধু পরিবারের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নির্দেশ থাকলেও বঙ্গবন্ধু ট্রাস্ট বা তার পরিবারের কাছ থেকে কোনো ধরনের অনুমতিও নেয়নি নাসিক।

জানা গেছে, ইতিমধ্যে বিষয়টি জাতীয় সংসদের নজরেও এনেছেন স্থানীয় এমপি শামীম ওসমান। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, শীতলক্ষ্যার পূর্ব পাড়ে বন্দরের শত বছরের ঐতিহ্যবাহী সোনাকান্দা মাঠে একটি ইকোপার্ক করতে গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম দফায় ৩০ কোটি টাকার টেন্ডার দেয় নাসিক। ওই টেন্ডারের সবগুলো কাজই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে গিলে ফেলেছেন মেয়র আইভীর ঘনিষ্ঠ ঠিকাদার আবু সুফিয়ান। ওই বিশাল মাঠটির পুরোটাই নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের নিজস্ব সম্পত্তি। কিন্তু নাসিক কর্তৃপক্ষ জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে কোনো অনুমতি নেয়নি কিংবা পার্ক তৈরি সম্পর্কে কোনো অবগতিপত্র দেয়নি।

জানা গেছে, পার্কটির নাম প্রথমে সোনাকান্দা ইকোপার্ক করার কথা ছিল। তবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মৌখিক বাধা আসার পর তা বঙ্গবন্ধুর ছোট ছেলে শেখ রাসেলের নামে ‘শেখ রাসেল ইকোপার্ক’ নামকরণ করে টেন্ডার দেওয়া হয়।

এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক আনিছুর রহমান বলেছেন, ‘সোনাকান্দা হাটের জায়গাটি আমাদের এবং সেখানে পার্ক করার জন্য সিটি করপোরেশন কোনো অনুমতি বা লিজের জন্য আবেদন করেনি। এমনকি আমাদের ন্যূনতম অবগত করারও প্রয়োজন মনে করেনি, যা কোনো আইনেই পড়ে না। ’

এদিকে ঐতিহ্যবাহী সোনাকান্দা হাট ও মাঠের জায়গায় পার্ক নির্মাণের ঘোষণার পর থেকেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে এলাকাবাসীর মধ্যে। এ ব্যাপারে বন্দর থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রশীদ জানান, জেলা প্রশাসনের প্রায় ১৪ একর নিজস্ব জায়গা বিনা অনুমতিতে দখল করে নাসিক এই পার্ক নির্মাণের কাজ করছে। আর এ জন্য তারা জাতির পিতার পরিবারের নামের অপব্যবহার করে আসছে।

তিনি বলেন, ‘মূলত পার্ক নির্মাণের নামে মেয়র আইভী শেষ মুহূর্তে নিজের আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন। ’

বন্দর উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও মহানগর জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক সানাউল্লাহ সানু বলেন, ‘আস্থাভাজন ঠিকাদার আবু সুফিয়ানের মাধ্যমে আইভীর পকেট ভারী করতেই এই পার্কটি করা হচ্ছে। এ জন্য বঙ্গবন্ধুর পরিবারের নামকে পুঁজি করা হয়েছে। পার্কের চেয়ে আমাদের বেশি প্রয়োজন রাস্তাঘাট আর ড্রেনেজ ব্যবস্থা। ’

অন্যদিকে নগরীর জিমখানা এলাকায় রেলওয়ের বিশাল লেক ও সংলগ্ন বস্তি দখল করতে পার্ক নির্মাণের জন্য কোটি টাকার টেন্ডার দিয়েছেন মেয়র আইভী। আর এটিও গেছে তার আস্থাভাজন আবু সুফিয়ানের পেটে। বিশাল ওই সম্পত্তির পুরোটাই রেল মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো অনুমতি নেওয়া বা তাদের জানানোর দরকার মনে করেনি। রেলওয়ের কর্মকর্তারা পার্কের কাজ পরিদর্শনে গিয়ে কাগজপত্র দেখতে চাইলে আইভীর চিহ্নিত ক্যাডাররা তাদের ওপর চড়াও হয়। জিমখানায় গড়ে ওঠা বস্তির প্রায় এক হাজার হতদরিদ্র পরিবারকে সেখান থেকে উঠে যেতেও বলা হয়েছে নাসিকের পক্ষ থেকে।

স্থানীয়রা জানান, জিমখানার লেকটি প্রয়াত পৌর চেয়ারম্যান নাজিম উদ্দিন মাহমুদের নামে নামকরণের দাবি ছিল বহু বছর ধরে। কিন্তু মেয়র আইভী ওই লেকটি তার প্রয়াত বাবা সাবেক চেয়ারম্যান আলী আহমদ চুনকার নামে নামকরণ করার সিদ্ধান্ত নেন। সে মোতাবেক সেখানে ওই নামের একটি সাইনবোর্ডও লাগানো হয়। কিন্তু আলী আহমদ চুনকা লেক কার্যক্রম বস্তিবাসীর বাধার মুখে পড়লে নতুন নাম দেওয়া হয় বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব পার্ক। একই সঙ্গে পার্কের কাজের টেন্ডার দেওয়া হয়। মূলত বিশাল ওই সম্পত্তি দখলের জন্যই বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের নামে পার্কের নাম দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন এলাকাবাসী।

নাসিক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পের জন্য ২২০ কোটি টাকা দিচ্ছে। এলাকাবাসীর আশঙ্কা, বিশ্বব্যাংকের ওই টাকার পুরোটাই আইভী সিন্ডিকেটের পকেটে যাবে। এদিকে একের পর এক সরকারি জায়গা দখল করতে বঙ্গবন্ধু পরিবারের নাম ব্যবহারের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।

এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু পরিবারের নাম ব্যবহার করতে হলে ওই পরিবারের কাছ থেকে অনুমতি প্রয়োজন। কিন্তু সিটি করপোরেশন কোনো অনুমতি নিয়েছে কি না আমরা জানি না। কেউ যদি বঙ্গবন্ধুর পরিবার ও দলের নাম ব্যবহার করে আখের গোছাতে চায়, তবে দলের নেতা-কর্মীরা তা কোনোভাবেই মানবে না। ’

এ ব্যাপারে মহানগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোকন সাহা বলেন, ‘বন্দরের সোনাকান্দা ও শহরের জিমখানা প্রকল্পে প্রশাসন এবং জনতার বাধা অতিক্রম করতেই বঙ্গবন্ধু পরিবারের নামের অপব্যবহার চলছে। কূটকৌশলের মাধ্যমে শতকোটি টাকার ভূমি গিলে খেতে এবং ঠিকাদারের মাধ্যমে কয়েকশ কোটি টাকা পকেটে ভরতেই এ কাজ করেছেন আইভী। ’

আওয়ামী লীগ নেতা ও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান দীপু বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ মহানগরীতে সিটি মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী কখনো জেলা প্রশাসনের খাসভূমি, কখনো রাজউকের জমি, কখনো রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তি দখল করেছেন। নগরীর মানুষ সে কারণে আইভীকে ভূমিদস্যু মনে করেন। শহরের থানা পুকুরপাড় একসময় মাঠ ছিল। ওই মাঠে দেশসেরা খেলোয়াড় সৃষ্টি হতো। অথচ মাঠটি পুকুরে রূপান্তর করা হয়। পার্ক না করে নির্মাণ করা হয় বিশাল বহুতল বাণিজ্যিক ভবন। একইভাবে জনগণের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে বোটখাল ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণ শুরু হয়।

পরিবেশ অধিদফতর ওই কাজ বন্ধ করে দেয়। আইভী নিজের এসব দুর্নীতি ও ভূমিদস্যুতা ঢেকে রাখতে বঙ্গবন্ধু পরিবারের নামের আশ্রয় নিচ্ছেন। অথচ তিনি বর্তমান সরকারের বিরোধিতা আর সমালোচনায় মুখর থাকেন। ’

নারায়ণগঞ্জ নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আরিফ আলম দীপু বলেন, ‘বিষয়টি অবশ্যই জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার শামিল। তাই জাতির জনকের পরিবারের সদস্যদের নাম ব্যবহারের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে কঠিনভাবে দেখা উচিত। ’

বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমান এমপি বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে ও রাজউকের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি বেদখল হয়ে আছে। গত বছর গণপূর্তমন্ত্রী নিজে নারায়ণগঞ্জে এসেছিলেন। তার নির্দেশের পর থেকে রাজউকের বেদখল সম্পত্তি উদ্ধার শুরু হয়। আমি মনে করি, রেল মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পর্যায়েরও উচিত নারায়ণগঞ্জে এসে তাদের বেদখল সম্পত্তি উদ্ধার করে আয়ের উৎস তৈরি করা। নারায়ণগঞ্জে রেলের যে সম্পদ রয়েছে, তা ব্যবহার করে নারায়ণগঞ্জবাসীকে উন্নত সেবা দেওয়া সম্ভব। আর এটি করা গেলে রেলওয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপ পাবে। ’

এদিকে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে মেয়র আইভীকে মোবাইলে কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। নাসিকের প্রধান নির্বাহী মোস্তফা কামালকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বিষয়টি মেয়রের সঙ্গে আলাপ করার পরামর্শ দেন।

উল্লেখ্য, জাতীয় সংসদে নাসিকে দুর্নীতি ও অনিয়মের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন তোলার পরপরই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গত বছর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি তাদের তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় বিষয়টি অধিকতর তদন্ত করতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বরাবর পাঠানো হয়। গুঞ্জন রয়েছে, দুদকের তদন্ত থামিয়ে দিতে ইতিমধ্যে ব্যাপক লবিং চলছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৬
এমজেএফ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।