ঢাকা, শনিবার, ৪ মাঘ ১৪৩১, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

২০২৪ সালে ৩১০ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা: আঁচল ফাউন্ডেশন

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০২৫
২০২৪ সালে ৩১০ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা: আঁচল ফাউন্ডেশন

ঢাকা: ২০২৪ সালে ৩১০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে বলে আঁচল ফাউন্ডেশনের এক জরিপে উঠে এসেছে। তাদের মধ্যে স্কুল, কলেজ , মাদরাসা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীও রয়েছেন।

আঁচল ফাউন্ডেশন আয়োজিত শনিবার অনলাইনে ‘২০২৪ সালে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা: সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরি’ এক সংবাদ সম্মেলনে এতথ্য জানানো হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০২২ সালে দেশে আত্মহত্যাকারী স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ৫৩২ জন এবং ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত এ ১২ মাসে মোট ৫১৩ জন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাদরাসাশিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। ২০২৪ সালে আত্মহত্যাকারী মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩১০ জন। এদের মাঝে স্কুল, কলেজ, মাদরাসা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীও রয়েছেন। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আত্মহত্যা সম্পর্কিত রিপোর্ট মিডিয়াতে কম এসেছে বলেই আমাদের গবেষকরা মনে করছেন।

২০২৪ সালে বিভিন্ন বয়সের মোট ৩১০টি আত্মহত্যার তথ্য পাওয়া যায়। বয়সভিত্তিক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ১৩-১৯ বছরে বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ের শুরু থেকে কিশোর কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। ২০২৪ সালের মোট আত্মহত্যাকারী মানুষের প্রায় ৬৫.৭ শতাংশ এ বয়সসীমার। আত্মহত্যার তালিকায় এর পরই রয়েছে ২০-২৫ বয়সসীমা যুবক-যুবতীরা।  

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গতবছর এ বয়সের আত্মহত্যা করেন প্রায় ২৪ শতাংশ। শিশুদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা গেছে। ১-১২ বছর বয়সী শিশুর আত্মহত্যার তথ্য উঠে এসেছে, যা প্রায় ৭.৪ শতাংশ। সবচেয়ে কম রয়েছে ২৬-৩০ বছর বয়সসীমার মানুষ। এ বয়সের ২.৯ শতাংশের কাছাকাছি।

২০২৪ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আত্মহত্যার প্রবণতা সব লিঙ্গের মধ্যে লক্ষ্য করা গেছে, তবে নারীদের মধ্যে এটি তুলনামূলকভাবে বেশি। মোট ৩১০ জন আত্মহত্যা করেছেন, এর মধ্যে নারী মোট আত্মহত্যার প্রায় ৬১ শতাংশ। এদিকে পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার হারও কম নয়; প্রায় ৩৮.৪ শতাংশ পুরুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। তৃতীয় লিঙ্গের এবং ট্রান্সজেন্ডারদের মধ্যে ১ জন করে আত্মহত্যা করেছেন, যা মোট সংখ্যার যথক্রমে  প্রায় ০.৩ শতাংশ এবং প্রায় ০.৩ শতাংশ।

এ পরিসংখ্যানটি নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার উচ্চ প্রবণতা এবং এর সম্ভাব্য সামাজিক ও মানসিক কারণগুলোর দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। নারী শিক্ষার্থীরা সাধারণত আত্মহত্যার ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তাই মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সহযোগিতা নারীদের জন্য আরও বেশি প্রয়োজন।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, এসএসসি বা সমমান অর্থাৎ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। ২০২৪ সালে আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে ৪৬.১ শতাংশ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থী। এর পরই উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের অবস্থান। এ হার ১৯.৪ শতাংশ। তাছাড়া, স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। তথ্যমতে ২০২৪ সালে এ পর্যায়ে আত্মহত্যার হার ১৪.৬ শতাংশ। এছাড়া প্রাথমিক স্তরে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মাঝেও আত্মহননের বিষয়টি লক্ষ্য করা গেছে।  

প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ স্তরের ৭.৪ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এছাড়া স্নাতকত্তোর ১.৯ শতাংশ, ডিপ্লোমা ০.৬ শতাংশ , সদ্য পড়াশোনা শেষ করা শিক্ষিত তবে বেকার ০.৬ শতাংশ।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, আত্মহত্যার ক্ষেত্রে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহননের ঘটনা সবচেয়ে বেশি, যা ৮৩.৫ শতাংশ আত্মহত্যার ক্ষেত্রে ঘটে। অন্যদিকে, বিষপানে আত্মহত্যার হার প্রায় ৮.৭ শতাংশ। ৪.৬ শতাংশ মানুষ অন্যান্য পদ্ধতিতে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন, যেমন: ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, পানিতে ডুব দিয়ে, ট্রেনে কাটা পড়ে, ছুরি দিয়ে আঘাত, ঘুমের ওষুধ খেয়ে ইত্যাদি। আত্মহত্যার ধরন বিবেচনায় নিয়ে মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করা সহজতর হতে পারে। দড়ি, বিষ, ছুরি ইত্যাদি ব্যবহারের প্রতি পরিবারের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সায়্যেদুল ইসলাম সায়েদ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক ড. মো. জামাল উদ্দীন, আইনজীবী ও লেখক ব্যারিস্টার নওফল জামির, আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সুস্থ দেহে সুন্দর মন অর্থাৎ জীবনের সামগ্রিক আনন্দ ও সুস্থতার জন্য দেহ ও মন পরস্পরের পরিপূরক। কিন্তু মনের খবর ঠিক রাখা হয়ে উঠে না আমাদের। যার ফলে খুব সহজেই আমরা হতাশা-বিষণ্ণতার মতো জটিল মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে পড়ি। আর এ হতাশা ও বিষণ্ণতার অশুভ চক্র থেকে বের হতে না পেরে বেছে নেই আত্মহত্যার পথ। আত্মহত্যা হলো ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের জীবন শেষ করার একটি চূড়ান্ত পদক্ষেপ। মানুষের মানসিক যন্ত্রণা, হতাশা এবং অসহায়ত্বের এক মারাত্মক বহিঃপ্রকাশ এটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করেন, যা প্রতি চল্লিশ সেকেন্ডে একজনের মৃত্যুর সমতুল্য।

বাংলাদেশেও আত্মহত্যা একটি ক্রমবর্ধমান সামাজিক সমস্যা হয়ে উঠেছে। সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে আত্মহত্যাকে নিষিদ্ধ এবং ঘৃণার চোখে দেখা হলেও প্রতিবছরই আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।  

উল্লেখযোগ্যভাবে, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ অপসংস্কৃতির প্রভাব খুব বেশি। প্রতিবছরের মতো এ বছরও আঁচল ফাউন্ডেশনের ‘রিসার্চ অ্যান্ড এনালাইসিস ইউনিট’ এর সদস্যরা দেশের জাতীয় ও স্থানীয় ১০৫ টিরও বেশি সংবাদপত্রে প্রকাশিত আত্মহত্যার সংবাদের তথ্য খুঁজে পায়।

আত্মহত্যা প্রতিরোধে আঁচল ফাউন্ডেশনের বেশকিছু সুপারিশ দিয়েছে। সেগুলো হলো- মানসিক স্বাস্থ্য অ্যাম্বাসেডর প্রোগ্রাম; বন্ধু সহযোগিতা গ্রুপ; লাইফ স্কিলস ওয়ার্কশপ; গেমিফিকেশন টেকনিক; ফিলিংস অ্যালার্ম সিস্টেম চালু; পারিবারিক কাউন্সেলিং প্রোগ্রাম; সৃজনশীল থেরাপি ক্লাস; ডিজিটাল মেন্টাল হেলথ ক্যাম্পেইন; ইত্যাদি।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০২৫
এমআইএইচ/জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।