ঢাকা, রবিবার, ৪ মাঘ ১৪৩১, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

বঙ্গবন্ধু-লালন শাহ সেতুর গ্যাসলাইন নির্মাণে কালক্ষেপণ

মফিজুল সাদিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৬
বঙ্গবন্ধু-লালন শাহ সেতুর গ্যাসলাইন নির্মাণে কালক্ষেপণ বঙ্গবন্ধু সেতু ও লালন শাহ সেতু

ঢাকা: একে একে ১০ বছর অতিবাহিত হলেও সম্পন্ন হয়নি বঙ্গবন্ধু সেতু ও লালন শাহ সেতুর উপর দিয়ে ৮২ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন লাইনের নির্মাণ কাজ। ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইনে দৈনিক ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সঞ্চালন সক্ষম লাইনটি এখনও লালন শাহ সেতু অর্থাৎ পদ্মা নদী অতিক্রম করতে পারেনি।



যথাসময়ে গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় সময়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বেড়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি ও ব্যয়ভার।
 
বঙ্গবন্ধু সেতু ও লালন শাহ সেতুর উপর গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণের জন্য ‘হাটিকুমরুল-ভেড়ামারা গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন প্রকল্পে’র কাজ শুরু হয়েছিল ২০০৬ সালের জুলাই ‍মাসে। গ্যাস সঞ্চালন লাইনটি বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পাড়, নল্কা, হাটিকুমরুল, ঈশ্বরদী হয়ে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা পযর্ন্ত বাস্তবায়িত হবে।
 
২০০৯ সালের জুন মাসের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নের কথা ছিল। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬২৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এর মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ঋণ ৩৪২ কোটি ১৭ লাখ টাকা। কিন্তু ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়নি, এ কারণে বার বার বেড়েছে ব্যয়ও।

একে একে ছয় বার সময় বেড়ে ডিসেম্বর ২০১৬ সাল নাগাদ ঠেকেছে। অন্য দিকে একই সময়ে ৬২৮ কোটি ৭০ লাখ টাকার প্রকল্পের ব্যয় এখন ৭৫০ কোটি ৬২ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
 
গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল) সূত্রে জানা গেছে, খুলনা, রাজশাহী ও এর আশপাশের এলাকার শিল্প, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহের লক্ষ্যে প্রকল্পটি শুরু হয়। ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইন স্থাপনের মাধ্যমে দৈনিক ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সঞ্চালনের জন্য প্রকল্পটি নেওয়া হয়। কিন্তু শুরু থেকেই সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির খেলায় মেতেছে প্রকল্পটি।

প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় বৃদ্ধি ও ধীরগতি প্রসঙ্গে জিটিসিএল-এর এক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, ‘প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে আন্তর্জাতিক বাজার যন্ত্রপাতি ও ইক্যুইপমেন্টের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান হ্রাসসহ কতিপয় নতুন কম্পোনেন্ট অন্তর্ভুক্তি হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পাড় থেকে নল্কা পযর্ন্ত পাইপলাইন নির্মাণে অর্থ সংকট দেখা দেয়। যে কারণে ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের ১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া হয়। এতে করে প্রকল্পের নাম পরিবর্ত করে ‘হাটিকুমরুল-ভেড়ামারা গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন প্রকল্প’ নামে নামকরণ হয়। এসব কাজের পরিবর্তন করতে গিয়েও সময় বৃদ্ধি হয়। ’

জিটিসিএল সূত্র থেকে আরও জানা গেছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে জিটিসিএল ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জার্মান ড্রিল টেকনোলজি বিবাদেও জড়িয়েছে। প্রকল্পের আওতায় চলমান কাজের বিপরীতে ঠিকাদারের বিল পরিশোধ ও প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের ব্যয় বৃদ্ধির কারণে প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়ে। গ্যাস লাইনটি এখনও লালন শাহ সেতু অথবা পদ্মা নদী অতিক্রম করাতে পারেনি জার্মান কোম্পানিটি। এই কোম্পানির ব্যর্থতার কারণেই মূলত প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কালক্ষেপণ হয়েছে। বর্তমানে এই অংশের কাজ হাতে নিয়েছে চায়না  পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ব্যুরো (সিপিপি)।

প্রকল্পের আওতায় কী কী কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং কী কী কাজ এখনও বাকি রয়েছে তা জানতে চাইলে জিটিসিএল-এর ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রকল্পের আওতায় টাঙ্গাইলের হাটিকুমরুল থেকে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা পযর্ন্ত ৮২ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ ও পাইপলাইনের সিপি সিস্টেম স্থাপন কাজ শেষ হয়েছে। হাটিকুমরুল থেকে পাবনার পাকশী পযর্ন্ত ৭৮ কিলোমিটার সিপি সিস্টেম কমিশনিং করা হয়েছে। কমিশনিং ব্যতীত সিজিএস-এর সমুদয় কাজসমূহ সমাপ্তির পর্যায়ে রয়েছে। সুপারভাইজরি কন্ট্রোল অ্যান্ড ডাটা অ্যাকুইজিশন (স্ক্যাডা) সিস্টেশ স্থাপন কাজের বিপরীতে মালামাল সংগ্রহের কাজ শেষ হয়েছে এবং মাঠ পর্যায়ে কাজ চলমান রয়েছে। পূর্ত কাজের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। ৫টি মধ্যে ৪টি নদীতে মোট ১ দশমিক ৪৬ কিলোমিটার রিভার ক্রসিং সম্পন্ন হয়েছে। ’

‘তবে ঠিকাদার পর পর দুই দফা পদ্মা নদী অতিক্রম কাজে ব্যর্থ হওয়ায় এবং বর্তমানে বিদ্যমান ঠিকাদার তৃতীয় দফা পদ্মা নদী অতিক্রম কাজে অনীহা প্রকাশ করায় তার চুক্তি বাতিল করে দরপত্র আহ্বান করা হয়। প্রাপ্ত দরপত্র মূল্যের ভিত্তিতে ডিপিপি সংশোধন করে তা অনুমোদনের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। ’

জিটিসিএল সূত্র জানায়, প্রকল্প বাস্তবায়নে বিবাদে জড়িয়ে জিটিসিএল এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জার্মান ড্রিল টেকনোলজি আদালত পযর্ন্ত গড়িয়েছে। ঠিকাদার পরপর দু’দফা কাজে ব্যর্থ হওয়ায় ১৮ ডিসেম্বর, ২০১১ সাল থেকে পদ্মা নদী অতিক্রমের কাযর্ক্রম বন্ধ করে দেয়। ঠিকাদার তাদের ব্যর্থ প্রচেষ্টার বিপরীতে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাবি করলে সার্বিকভাবে বিষয়টি জিটিসিএল-এর বিবেচনায় নেওয়া হয়। জিটিসিএল ঠিকাদারদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলাকালীন অবস্থায় ঠিকাদার ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য অপ্রত্যাশিতভাবে আইনের আশ্রয় নেয়। এ অবস্থায় জিটিসিএল ও পাল্টা আইনের আশ্রয় নেয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় কোর্টের রায় জিটিসিএল-এর অনকূলে আসে। কোর্টের রায় অনুযায়ী ঠিকাদার প্রায় ৩৩ কোটি টাকা দিয়ে ফের কাজ শুরু করতে আগ্রহ প্রকাশ করে।

এরপরও ঠিকাদার নানা অজুহাতে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কালক্ষেপণ করতে থাকে। অনেক বার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও প্রকল্পের কাজ শুরু করেনি ঠিকাদার জার্মান টেক। এর কাজ শুরু করার জন্য জিটিসিএল ঠিকাদারদের চিঠি পাঠায়। জিটিসিএল চিঠির কোনো উত্তর পায়নি ঠিকাদারের কাছ থেকে। এর পরে ২৫ মার্চ ২০১৫ সালে থেকে ঠিকাদারি চুক্তি বাতিল করা হয়। এতে করে থেমে থাকে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ।

প্রকল্পের আওতায় স্ক্যাডা সিস্টেম স্থাপন ও হাই ডেফিনেশন (এইচডি) পদ্ধতি সম্পন্নকরণের লক্ষ্যে চারবার প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। যে কারণে ভেড়ামারায় অবস্থিত ৬০ মেগাওয়াট এবং ঈশ্বরদীতে প্রস্তাবিত ৪৫০ মেওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রে এলাকায় ১০ বছরে প্রাকৃতিক গ্যাস পৌঁছায়নি। কবে নাগাদ পৌঁছাবে পরিষ্কারভাবে বলতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা।

ভেড়ামারা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমাদের ভেড়ামারা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে এখনও গ্যাস আসেনি। কবে গ্যাস আসবে আমাদের জানা নেই। গ্যাস আসবে আসবে করে ১০ বছর গত হয়েছে। ’

তবে চলতি বছরের জুন মাসে প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণ হবে বলে জানা গেছে। জিটিসিএল এমডি নিজাম শরিফুল ইসলাম  বাংলানিউজকে বলেন, ‘আশা করছি চলতি বছরের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারবো। প্রকল্পের অধিকাংশ কাজ শেষ হয়েছে। শুধু পদ্মা নদী অতিক্রমের কাজ বাকি ছিল। এর আগে জার্মান টেক কোম্পানি প্রকল্পের কাজ করতে ব্যর্থ হয়। তবে এবার ভালো কোম্পানিকে দিয়ে কাজ করাচ্ছি। ’

বাংলাদেশ সময়: ১২৪৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৬
এমআইএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।