খুলনা: খুলনা আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক (আরসি ফুড) কাজী নুরুল ইসলামের কোটি টাকার বদলি বাণিজ্যকে ঘিরে আট সদস্যের একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। ওই সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই গোটা খুলনা বিভাগের ১০ জেলার খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসিএলএসডি) বদলির কোটি কোটি টাকার হাতবদল হচ্ছে।
ওই সিন্ডিকেটের সহায়তায় দুর্নীতির দুর্গে পরিণত হয়েছে খুলনা আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়।
অভিযোগ রয়েছে, চলাচল ও সংরক্ষণ নিয়ন্ত্রক নকীব সাদ সাইফুল ইসলাম, তার আস্থাভাজন খাদ্য পরিদর্শক বাদল বিশ্বাস, বাগেরহাট জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক বাবুল হোসেন, যশোরের খাদ্য নিয়ন্ত্রক কামাল হোসেন, ঝিনাইদহ সদর খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন, খুলনার ফুলতলা খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা অনিন্দ কুমার, সাতক্ষীরা সদর খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা আশরাফুজ্জামান ও পাটকেলঘাটা খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা তৈয়বুর রহমান মিলে এ সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন।
ফলে তাদের আস্থাভাজন হয়ে নির্ধারিত ঘুষের টাকা দিয়েই পোস্টিং কিংবা বদলি ঠেকাতে হচ্ছে। বদলি বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাচ্ছেন এ সিন্ডিকেটের সদস্যরা। এ ক্ষেত্রে আরসি ফুড কাজী নুরুল ইসলামের ‘পকেটের লোক' খ্যাত নকীব সাদ সাইফুল ইসলাম, তৈয়বুর রহমান, জসিম উদ্দিন ও কামাল হোসেন এগিয়ে বেশি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, খুলনার আরসি ফুড কাজী নুরুল ইসলামের পদোন্নতি হওয়ার কথা রয়েছে। একারণে তার খুলনা থেকে বদলি হতে হবে। নিজের বদলি পূর্ববর্তী সময়ে এ বদলি বাণিজ্যে গোটা বিভাগের খাদ্য কর্মকর্তাদের মধ্যে জোর সমালোচনা চলছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে একাধিক খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, ‘চাকরিতে পুরাতন কোনো কর্মকর্তা কিভাবে ওই সিন্ডিকেট চক্রের কাছে গিয়ে বদলির জন্য মাথা ঠুঁকবে? আগে অল্প টাকায় বদলি হতো, এখন তা ৪-৫ লাখে উঠেছে। বর্তমান আরসি ফুড ওই টাকার ভাগ খাদ্য মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে পার্সেন্ট দেওয়ার নামে এতো বেশি টাকা ঘুষ আদায় করছেন। কিছু দুর্নীতিবাজ ওসিএলএসডি ব্যবসায় পুঁজি বিনিয়োগের মতো ৪-৫ লাখ টাকায় পোস্টিং নিয়ে দুর্নীতি করে ডাবল কামাচ্ছে। যা সবার পক্ষে সম্ভব নয়।
ঝিনাইদহের একজন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, ঝিনাইদহ সদরসহ কয়েকটি গুদামে কিছুটা নিম্নমানের পুরাতন চাল কেনা হয়েছে। অথচ, তাদের কোনো সমস্যা নেই। ওইসব কথা জানলেও ডিসি ফুড, আরসি ফুড তদন্তের পরিবর্তে তাদের শেল্টার দেয়। অথচ, চাকরিতে পুরাতনদের ভালো কাজের স্বীকৃতিও অবৈধ টাকার কাছে বিলিন হয়ে পড়েছে। তবে আরসি ফুডের পাশাপশি তার ‘পকেটের লোক’ নামধারী দালালরা বিপুল অর্থের মালিক হচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, খাদ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী চাকরির বয়স তিন বছর পূর্ণ না হলে সরাসরি গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া যাবে না। অথচ আরসি ফুড কাজী নুরুল ইসলাম মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে চাকরির বয়স দুই বছর পূর্ণ না হতেই আবু বক্কর সিদ্দিক নামে একজনকে সাতক্ষীরার কলারোয়া খাদ্য গুদামে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব দেন। সম্প্রতি আবু বক্কর সিদ্দিকীকে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে বদলি করা হলেও ১৫দিনের ব্যবধানে তাকে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা হিসেবে বদলির আদেশ দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, ২০১০ সালে উপ-খাদ্য পরিদর্শক পদে চাকরিতে যোগ দেওয়া আবু বক্কর সিদ্দিকী পরবর্তীতে নতুন নিয়োগে পরীক্ষার মাধ্যমে খাদ্য পরিদর্শক পদে যোগ দেন। তবে আগের পদে চাকরির সরকারি তথ্য গোপন করে তিনি নতুন পদে যোগ দিয়েছেন।
এছাড়াও দুর্নীতির দায়ে মেহেরপুর সদর খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীরের বিরুদ্ধে দুদক মামলা করলে খাদ্য অধিদপ্তর তাকে তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ গুদামে বদলির নির্দেশনা দেন। তবে সম্প্রতি মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে তিনি খুলনা বিভাগের অপেক্ষাকৃত বৃহৎ গুদাম কুষ্টিয়া সদরে দায়িত্ব পেয়েছেন। বিষয়টি পুরো বিভাগের খাদ্য গুদাম কর্মকর্তাদের অবাক করেছে।
খাদ্য গুদামের একাধিক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, আরসি ফুড কাজী নুরুল ইসলাম বদলি বাণিজ্য ছাড়াও ধান, চাল ক্রয়, অটো মিলের পাক্ষিক ক্যাপাসিটি বাড়াতে ঘুষ বাণিজ্য, প্রতিটি গুদাম থেকে মাসোহারা আদায় করে আড়াই বছরে কয়েক কোটি টাকা ঘুষ আদায় করেছেন। এসব টাকা কোন খাতে ব্যয় করা হচ্ছে তা গোয়েন্দা নজরদারি ও দুদকের নিরপেক্ষ তদন্তে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
চলাচল ও সংরক্ষণ নিয়ন্ত্রক নকীব সাদ সাইফুল ইসলাম শুক্রবার (৩০ সেপ্টেম্বর) বিকেলে বাংলানিউজকে বলেন, আমার কোনো বক্তব্য নেই। যা ইচ্ছা লেখেন। ঘুমাচ্ছিলাম রাখি।
পাটকেলঘাটা খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা তৈয়বুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, বদলি ঠিক করা আমার দায়িত্ব নয়। যা শুনছেন তা ভুল।
যশোরের খাদ্য নিয়ন্ত্রক কামাল হোসেনের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এ সব অভিযোগের ব্যাপারে খুলনা আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক (আরসি ফুড) কাজী নুরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই বদলি করা হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অনিয়ম করা হচ্ছে না বলেও দাবি করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১২০৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ০১, ২০১৬
এমআরএম/এসএইচ
**খুলনা আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কোটি টাকার বদলি বাণিজ্য