ঢাকা: জমি কেনা-বেচায় স্বচ্ছতা আনতে এবং রাজস্ব ফাঁকি রোধে সকল মৌজার জমির দর পুন:নির্ধারণের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত সপ্তাহে দুদকের এই চিঠি এসে পৌঁছায় সচিবালয়ে।
দুদকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এক ব্যবসায়ী রাজধানীর বড় মগবাজার এলাকায় বাড়িসহ পাঁচ শতাংশ জমি কেনেন। জমির মালিক, দলিল লেখক ও সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রারকে ম্যানেজ করে রেজিস্ট্রেশনের সময় দলিলে ‘দালান বাড়ি’ শ্রেণির জমিকে ‘নাল’ শ্রেণি বলে উল্লেখ করে রেজিস্ট্রেশন করেন। মগবাজার মৌজায় ‘দালান বাড়ি’ শ্রেণিভুক্ত এক শতাংশ জমির রেজিস্ট্রেশন ফি ৪২ লাখ ৬৫ হাজার ৫০০ টাকা। আর নাল জমির রেজিস্ট্রেশন ফি ১৩ লাখ ৮৭ হাজার ২০০ টাকা। ফলে প্রতি শতাংশ জমিতে রেজিস্ট্রেশন ফি ফাঁকি দেওয়া হয় ২৮ লাখ ৭৮ হাজার ৩০০ টাকা। পাঁচ শতাংশ জমি রেজিস্ট্রেশন করতে গিয়ে ওই ব্যবসায়ী এক কোটি ৪৩ লাখ ৯১ হাজার ৫০০ টাকা সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেন। দলিলে জমির প্রকৃত শ্রেণি উল্লেখ করে রেজিস্ট্রেশন করা হলে এই বিপুল পরিমাণ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা পড়তো।
বিষয়টি উল্লেখ করে দুদকের চিঠিতে বলা হয়েছে, উপরের উল্লেখিত উদাহরণ ছাড়াও অনুসন্ধানে দেখা গেছে প্রকৃতপক্ষে দেশের সবগুলো মৌজাতেই সরকার নির্ধারিত মূল্যের কয়েকগুণ বেশি দামে জমি ও ফ্ল্যাট কেনা-বেচা হচ্ছে। কিন্তু দলিলে দেখানো হয় সরকার নির্ধারিত দর। সরকারকে রাজস্ব ফাঁকি দিতেই প্রকাশ্যে চলছে এই অনৈতিক কাজ। ফলে এ খাতে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
এমন রাজস্ব ফাঁকির পদ্ধতি দুর্নীতিকে উৎসাহিত করছে বলে মনে করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের মতে, ‘হস্তান্তরিত মূল্যের চেয়ে দলিলে লিখিত মূল্য অনেক কম হওয়ায় অপ্রদর্শিত অর্থের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। যা বাস্তবে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করছে। ’
এই অবস্থা দূর করতে রাজধানীসহ সারাদেশের জমি ও ফ্ল্যাটের প্রকৃত বাজারমূল্য নির্ধারণ করতে গত ২০ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠিটি পাঠায় দুদক।
দুদক সচিব আবু মো. মোস্তফা কামালের সই করা ওই চিঠিতে জমি ও ফ্ল্যাটের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণে কমিটি গঠন করাসহ ৬ দফা সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-ঢাকার ক্ষেত্রে জমির প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করতে জেলা প্রশাসন, রাজউক, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, গণপূর্ত বিভাগ, এসবি এবং এনএসআই-এর সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা। তারা সংশ্লিষ্ট এলাকায় জমি ও ফ্ল্যাটের প্রকৃত বাজারমূল্য যাচাই করে একটি প্রতিবেদন দাখিল করবেন। ওই প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে সরকার সর্বনিম্ন বাজার মূল্য নির্ধারণ করবে। যে সব মৌজার পরিধি অনেক বড় সে সব ক্ষেত্রে জমির ব্যবহার ও অবস্থানগত বিবেচনায় একাধিক ক্লাস্টারে ভাগ করে বাজারমূল্য নির্ধারণ করার কথা উল্লেখ করা হয় দুদকের সুপারিশে। ঢাকার বাইরের জেলার ক্ষেত্রে বিদ্যমান বাজার মূল্য নির্ধারণ কমিটির স্থলে ডিসির নেতৃত্ব রেজিস্ট্রেশন বিভাগ, গণপূর্ত বিভাগ, গোয়েন্দা সংস্থা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জনপ্রতিনিধি ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে নতুন কমিটি গঠন করার সুপারিশ করা হয়েছে।
কমিটি শুধুমাত্র দলিলে লিখিত জমির মূল্যের উপর নির্ভর না করে সঠিক তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করবে। প্রয়োজনে প্রতিবেশী দেশসমূহের সংশ্লিষ্ট আইন, পদ্ধতি ও জমি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা পরীক্ষা করার পরামর্শও দেওয়া হয় চিঠিতে।
সুপারিশে আরো বলা হয়-অপ্রদর্শিত অর্থ দ্বারা জমি ও ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে শুধু একবারের জন্য নির্দিষ্ট হারে ট্যাক্স প্রদানের মাধ্যমে অর্থের বৈধতাপ্রাপ্তির সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে আয়কর সর্ম্পকিত বিধি অনুযায়ী হতে হবে। বারবার এ সুযোগ দেয়া হলে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা হয়।
দুদক সূত্র জানায়, ঢাকাসহ সারাদেশের জমি ও ফ্ল্যাটের বাজার মূল্যের সঙ্গে সরকার নির্ধারিত মূল্যের বড় ধরণের পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্যের কারণে প্রতি বছর সরকার বড় অংকের রাজস্ব আয় বঞ্চিত হচ্ছে। এ অসঙ্গতি দূর করতে গত ৩১ আগস্ট দুদক চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে অর্থ বিভাগ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, ভূমি মন্ত্রণালয়, আইন ও বিচার বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট দফতরের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
ওই বৈঠকে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, দেশে জমি, বাড়ি ও ফ্ল্যাট প্রতিনিয়ত ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে। রাজস্ব নিশ্চিত করতে সরকার জমির ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু এগুলোর বাস্তব মূল্য লিখিত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি।
এ অবস্থার উত্তরণ করতে হলে জমি ও ফ্ল্যাটের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখে দাম নির্ধারণ করতে হবে। এতে দুর্নীতি কমবে এবং সরকারের রাজস্ব আরো বৃদ্ধি পাবে।
এদিকে দুদকের এই চিঠির প্রেক্ষিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শিগগিরই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) চিঠি দেবে বলে জানিয়েছে দায়িত্বশীল সূত্র।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন পদস্থ কর্মকর্তা জানান, দুদকের চিঠির বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে দু’একদিনের মধ্যে সব ডিসিদের চিঠি পাঠানো হবে।
প্রসঙ্গত, ঢাকাসহ সারাদেশের জমি নানা শ্রেণিতে বিভক্ত। এরমধ্যে বাড়ি, ভিটা, চালা, পতিত, নাল, ডোবা, বাগান, আবাদি, সাইল, টেক, ঘুনি, টাটি, পুকুর, খামারসহ নানা শ্রেণি রয়েছে। একেক শ্রেণির জমির রেজিস্ট্রেশন, নামজারির ফি’র হারও একেক রকম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশনের সময় নাল জমিকে ডোবা দেখানো হয়। নিম্ন শ্রেণির উল্লেখ করে জমির মূল্যও কম দেখানো হয়। জমির মূল্য কম হলে রেজিস্ট্রেশন ফি কম হয়।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০১৬
আরএম/আরআই