বুড়িগঙ্গা ঘুরে: ‘নদীর টান এড়ানো এতো সহজ নয়, এর বাঁধনে আটকেই গত পঞ্চাশটা বছর এঘাট-ওঘাট করে কাটিয়ে দিলাম। নদীতেই গোসল; হাত-মুখ ধোয়া; প্রয়োজনে নদীর জলেই ওজু, সবই চলে প্রিয় বুড়িগঙ্গায়।
অবলিলায় এমন কথা বলে গেলেন ছোলা-ঘুগনি বিক্রেতা মো. আক্তার হোসেন। রাজধানী ঢাকার বাবুবাজার, বাদামতলী ও জিঞ্জিরা এলাকায় বেশ সুপরিচিত এই বৃদ্ধ হকার। তার বয়স যে এতোটা হয়েছে, সে কথা টের পাওয়াই মুশকিল হতো, যদি না তিনি কথায় কথায় পঞ্চাশ বছরের প্রসঙ্গটা না আনতেন। ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ এখনও বেশ প্রাণবন্ত, হাঁকডাকের মানুষ।
বাদামতলীতে ভর দুপুরে কাস্টমার কম বলেই কিনা খানিকক্ষণ আড্ডা দিতে পারলেন। কিন্তু ক’জন খদ্দের আসতেই ঘুগনি মাখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আক্তার হোসেন। এক ফাঁকে কেবল বললেন, আগে দেখেছি যৌবন, তখন নদীর পানিও ছিল টলটলে। এখন ময়লা-গন্ধ হলেও আমার কাছে পরম আত্মীয় এই নদী। তাই পারি না মন্দ কিছু বলতে।
একটু দূরেই (বাদামতলীর পাশে) লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপির আওয়াজ। জলে ঝাঁপিযে পড়ার খেলায় মেতেছে নদী পাড়ের মানুষ। এই ঝাঁপ দেবেন-দেবেন, এমন সময় কথা হলো মধ্যবয়সী ফিরোজের সঙ্গে। এমন পানিতেও কি গোসল সম্ভব?- প্রশ্ন শুনে বিব্রত হয়ে উত্তর, রোজই তো করি। গোসলে আমাদের নদীই তো ভরসা।
কোনো খোসপাঁচড়া বা অন্যকোনো চর্মরোগ? জবাবে একটু ভেবে বলেন, মাঝে মধ্যে একটু চুলকায়, আর তেমন কিছুই হয় না।
এরই মধ্যে দৌড়ে ঘাটে এলেন এক যুবক। নাম তার শান্ত। ঠেলেন ভ্যানগাড়ি। বাংলানিউজকে বলেন, কর্মজীবী মানুষ, বাইরে গোসল করতে লাগবে ১০ কি ১৫ টাকা। এর থেকে নদীই শ্রেয়, উন্মুক্ত জলরাশিতে দারুণ ডুব, তাতেই জগতের প্রশান্তি।
‘যাদের অভ্যাস আছে তারাই এখনো আসেন নদীতে গোসলে। এটা একটা ট্রাডিশন (ঐতিহ্য)। আসতেই হবে, এক্ষেত্রে পানি ময়লা কি কালো সেটি বিবেচ্য না,’- গোসলরত অবস্থায় জোরে আওয়াজ দিয়েই বলেন সামাদ। পেশা তার শ্রমিকের।
ঠিক মতো ড্রেজিং করলে আর বাইরের ময়লা-আবর্জনা (ডাস্টবিনের ময়লা) ও কলকারখানার বর্জ্য নদীতে না ফেললে বুড়িগঙ্গার এতো দুর্দশা হতো না বলে মনে করেন সামাদ।
ফল ব্যবসায়ী সালামও সমর্থন জানান তার কথায়। তিনি বলেন, শীতে নদীর পানিতে দুর্গন্ধ বেশি থাকে। গরমে (গ্রীষ্ম) এটি কমতে কমতে বর্ষায় দারুণ উন্নতি হয়। এই ধারাটাই সরকার যদি কেবল ধরে রাখতে পারে, তবে নদীর রূপ সারাবছরই বর্ষার মতো ফকফকে থাকবে।
তাদের মতো এমন হাজারো মানুষের প্রতিদিনকার গোসল, মুখ-হাত ধোয়া ঢাকার মাতা বুড়িগঙ্গায়। ফিরোজ, শান্তদের পাশাপাশি আবু তাহের, ফারুকদের রোজকার গন্তব্য নদীর বিভিন্ন ছোট-বড় ঘাট। কারো মিটফোর্ড ঘাট, কারো বাবুবাজার, জাহাজঘাট, শ্যামবাজার ঘাট, সোয়ারিঘাট, ওয়াইজ ঘাট, সদরঘাট, বাদামতলী ঘাট, কেরানীগঞ্জের কেজিশাহ ডক ঘাট, ব্রিজঘাট কিংবা কারো কালীগঞ্জ ঘাট।
সূর্যের কিরণ যতক্ষণ থাকে ততক্ষণই স্নানে মগ্ন মানুষের ভিড় মনোযোগ কাড়ে। কেবল পুরুষ নয়, ঘাটে ঘাটে নারীদেরও বুড়িগঙ্গার পানিতে স্নান সেরে নিতে দেখা গেলো। পানি যত দূষিতই হোক, গোসলটা বুড়িগঙ্গাতেই সারতে হয় তাদের।
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৯, ২০১৬
আইএ/জেডএম