আপনাকে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি। নিজেই অনুসন্ধান করুন।
নিজের দপ্তরে বসে বাংলানিউজকে এ কথাই বলছিলেন, কেরানীগঞ্জের রাজেন্দ্রপুরে নবনির্মিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রথম জেলার নেছার আলম।
পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে ১৭৮৮ সালে তৈরি হওয়া কারাগারটি এখন স্থান করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। বন্দিদের নতুন ঠিকানা রাজেন্দ্রেপুরের এই কারাগার।
যাকে কেবলমাত্র দেশেরই নয়, বলা হচ্ছে এশিয়ার অন্যতম আধুনিক কারাগার। ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা কারাগারের লাল দেয়ালের পরিবর্তে সাদা রঙের বর্ণচ্ছটা। তুলনামূলকভাবে খোলামেলা ও নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলা হয়েছে গোটা এলাকা। কারাগার ঘিরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সাদা পোশাকে বিভিন্ন সংস্থার গোয়েন্দার সদস্যরা। পাশাপাশি একটু পর পর সাইরেন বাজিয়ে পুলিশ ও র্যাবের টহল দলের আনাগোণা।
গত বছরের ১০ এপ্রিল কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়া ইউনিয়নের বাঘৈর ও পশ্চিমদি মৌজার ১৯৫ একর জায়গায়জুড়ে নির্মিত আধুনিক এই কারাগারটির উদ্ধোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৪ হাজার ৫৯০ জনের ধারণক্ষমতার এ কারাগারে প্রায় ৮ হাজার বন্দি রাখা যাবে বলে জানাচ্ছেন কর্মকর্তারা।
আশির দশকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার স্থানান্তর নিয়ে আলাপ আলোচনার সূচনা। প্রায় তিন দশক পর ২০০৬ সালে বিষয়টি ওঠে একনেকে। সেখানে অনুমোদনের পর জমি অধিগ্রহণ। পরের বছর সেপ্টেম্বরে শুরু হয় ৪০৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকার এ প্রকল্পের কাজ।
ঢাকা–মাওয়া সড়ক ঘেঁষেই কারাগারের প্রধান ফটক। সেখানে পরিচয় দিয়ে নিজের নাম ও মোবাইল ফোন নম্বর লিপিবদ্ধ করে প্রায় দু’শ গজ এগিয়ে ভেতরে মূল কারাগার।
কারাগার ঘিরে চারপাশে রয়েছে ৪০ ফুট উঁচু চারটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। ফটকের বাঁপাশে রিজার্ভ গার্ড হাউজ, সামনে ক্যান্টিন। বাঁয়ে বন্দিদের সঙ্গে স্বজনদের সাক্ষাৎকার ভবন। কারাগার ঘিরে ১৮ ফুট উচ্চতার সীমানা প্রাচীর। তার ওপর আবার দুই ফুট বৈদ্যুতিক তারের সেন্সর। দেয়াল টপকে পালিয়ে যেতে চাইলে নিশ্চিত বৈদ্যুতিক শক। যার স্পর্শে আসা মাত্রই বেজে উঠবে নিরাপত্তা ঘণ্টা।
ভেতরে নদীর নামে আটটি ছয়তলা ভবন। যার প্রতিটি তলায় রয়েছে ৪০টি করে কক্ষ। ২০ হাত দৈর্ঘ্য ও ১০ হাত প্রস্থের প্রতিটি কক্ষে চারটি করে সিলিং ফ্যান। পাশেই বাথরুম। প্রতি কক্ষের ধারণ ক্ষমতা ১৩ জন বন্দি বা হাজতির। এর মধ্যে ছয়টিতে হাজতি আর অবশিষ্ট দুটি ভবনে রাখা হচ্ছে কয়েদিদের। প্রতিটি ভবনের আবার রয়েছে প্রায় ছয়ফুট উচ্চতার আলাদা আলাদা ছোট প্রাচীর। এছাড়াও ডিভিশনপ্রাপ্ত (ভিআইপি) বন্দিদের জন্য ১৬টি বিশেষ কারাকক্ষ ছাড়াও নির্মিত হচ্ছে, চারটি চারতলা ভবন। যার একটিতে ২’শ নারী বন্দি ছাড়াও ডেঞ্জার সেল নামে অন্য ভবনগুলোয় থাকবে ৪শ‘ দুধর্ষ জঙ্গি ও সন্ত্রাসী।
ঢাকা-মাওয়া সড়কের দক্ষিণে রাজেন্দ্রপুরে নতুন এই কারাগারে থেকে নাজিম উদ্দিন রোডের পুরনো কারাগারের দূরত্ব মাত্র ১২ কিলোমিটার। এই দূরত্ব থেকে অনিয়ম, দুর্নীতি আর হয়রানির দূরত্ব কতটা সেটা জানতেই নতুন কারাগারের বাইরে খোঁজ নেয় বাংলানিউজ। সঙ্গী বাংলানিউজের কেরাণীগঞ্জ প্রতিনিধি নাজিম উদ্দিন ইমন।
জেলারের কক্ষের সামনে উঁটু ফটক। তার বাইরে সম উচ্চতার আরেকটি ফটক পেরিয়ে তবেই মূল কারাগার। ভিজিটিং কার্ড দিতেই সাক্ষাতের জন্য ডাক পড়ে। ভেতরে সহকর্মীদের নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন জেলার নেছার আলম। সই করছেন একের পর এক ভাউচারে। খোঁজ খবর নিচ্ছেন বন্দি ব্যবস্থাপনার।
‘কারাগারের বিষয় জানতে চান। কেউ তো আমাদের সম্পর্কে ইতিবাচক কোনো খবর লেখে না। সবাই কেবল নেতিবাচক খবরই পরিবেশন করে। ’ কিছুক্ষণের নীরবতা। আক্ষেপটা চাপা দিয়েই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন নেছার আলম।
এখানে পাবেন না কোনো মাদক। কোনোভাবেই মাদক প্রবেশের সুযোগ নেই এই কারাগারে। নেই টাকা-পয়সার খেলা, যোগ করেন তিনি।
লাল দালানের পরিবর্তে সাদা দালানে এসে আসলে খোলনচলচেই বদলে গেছে কারা ব্যবস্থাপনার। যেটা এখন বিশাল এক সংশোধানাগার। আর তা সম্ভব হয়েছে কারা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক (আইজি-প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন স্যারের নেতৃত্বে, বলেন নেছার আলম।
জেলারের বক্তব্য যাচাই করতে পরিচয় গোপন রেখেই শুরু হয় অনুসন্ধান। বন্দিদের সাক্ষাৎকার ভবনে গিয়েই চোখে পড়ে বদলে যাবার চিত্র। না, কোনো অর্থের দাবি নয়। টোকেন নিতে হবে। তারপর নির্দিষ্ট সময়ে (আধা ঘণ্টা) বন্দির সাথে স্বজনের সাক্ষাৎ। তাও আবার বন্দির মর্যাদা ভেদে পাক্ষিক বা মাসে একদিন করে। সেলে খবর দেওয়া মাত্রই চলে আসছেন বন্দি বা হাজতিরা। কেউ বিলম্ব করলে মাইকিং করে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে তার স্বজন আগমনের খবরটি।
কারাগারের খাবার পছন্দ না হলে হাজতি বা বন্দির পছন্দের খাবার কেনার জন্য রয়েছে ব্যক্তিগত তহবিলে (পিসি) অর্থ জমা রাখার সুবিধা। সেখানে আগে অর্থ জমা দিলে একটি নির্দিষ্ট অংশ চলে যেতে সংশ্লিষ্টদের পকেটে। এখানে সেটা নেই। যেটা জমা দেওয়া হচ্ছে, সেটাই জমা হচ্ছে হাজতির হিসেবে। আগে কারাগারে বিকল্প মুদ্রামান ছিলো সিগারেট ও মাদক। এখানে এখনও সেটায় বেশ কড়াকড়ি। মাদক প্রবেশের সুযোগ নেই। কেউ নিয়ে ধরা পড়লেও রক্ষা নেই!
বন্দিদের সাক্ষাৎকার ভবন ঘিরে ইউনিফর্ম ও সাদা পোশাকে কারারক্ষীদের নজরদারি। দোতলা ভবনটির ভেতরে ঢুকলে কানে আসে কেবল মাছির মতো ভন ভন শব্দ। কে যে কী বলছেন, তা বোঝাও মুশকিল। তবে সান্ত্বনা আর স্বস্তি। দেখা সাক্ষাতের জন্যে এখানে টাকা পয়সার বালাই নেই।
সেখানে দায়িত্বে ছিলেন ময়মনসিংহের বাসিন্দা কারারক্ষী শফিকুল ইসলাম। পরিচয় গোপন রেখে বললাম, ভাই স্পেশাল করে এখানে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে টাকা পয়সার কোনো ব্যাপার-স্যাপার আছে কি’না?
‘পাগলে পাইছেন! হেইডা আগের জেলখানায় চলতো। এখানে সম্ভব না। ধরা পড়লে চাকরি নাই’।
তাহলে চলে ক্যামনে?
‘ক্যান সরকার বেতন দ্যায় না। ওতেই ভালোভাবে চইল্যা যায়’- বেশ মর্যাদা আর র্গবসহকারে বুক ফুলিয়ে উত্তর দেন কারারক্ষী শফিকুল ইসলাম।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০১৭
এমজেএফ