ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১ মাঘ ১৪৩১, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

অন্ধত্বে অভিশপ্ত বগুড়ার ছোট বালুয়া গ্রাম

বেলাল হোসেন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৩৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১৭
অন্ধত্বে অভিশপ্ত বগুড়ার ছোট বালুয়া গ্রাম ছেট বালুয়া গ্রামে জন্মগতভাবে অন্ধ ১৬ জন বংশ পরম্পরায় আত্মীয়। ছবি: আরিফ জাহান

সোনাতলার ছোট বালুয়া গ্রাম ঘুরে: ফুল আছে, পাখি আছে। সূর্য আছে, চন্দ্রও আছে। আছে রোদ-ছায়ার খেলা, এমনকি প্রকৃতির সবচেয়ে সুন্দর উপহার জোছনাও। বাংলাদেশের আর ১০টা গ্রামের মতোই সবুজের চাদের সুশোভিত ছোট বালুয়া। 

কিন্তু বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার এ গ্রাম যেন প্রকৃতির হেয়ালিতে কী এক অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছে। নইলে একটা গ্রামে ২২ জনই জন্মের সময় দৃষ্টিহীন হয়ে আসবেন কেন? ছোট বালুয়ার এ দৃষ্টিহীনদের ৬ জন কখনো আলো দেখেননি, জগতের মায়া ছেড়েছেন সুন্দর দুনিয়াকে এক নজর না দেখতে পেরেই।

এখন অন্ধত্বের অভিশাপ বয়েই বেঁচে আছেন ১৬ জন।

জন্মগতভাবে অন্ধ এই ১৬ জন বংশ পরম্পরায় আত্মীয়। বলাই যায়, দৃষ্টিহীনতা তাদের বংশগত অভিশাপ।
 
যদিও এদের অনেকেই চোখের চিকিৎসা করাতে এক সময় রাষ্ট্রীয় খরচে ভারতের মাদ্রাজ পর্যন্ত গেছেন। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। মাদ্রাজের চিকিৎসকরা জানিয়ে দেন, জন্মগতভাবে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন তারা। ফলে চিকিৎসা বা অন্য কোনোভাবে সেই হারানো দৃষ্টিশক্তি ফেরানো সম্ভব নয়।
 
এরপর তাদের দৃষ্টিশক্তি ফেরাতে আর কেউ চিকিৎসার জন্য উদ্যোগী হয়নি। আর্থিক অসচ্ছলতায় তাদের পক্ষেও চিকিৎসার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। স্বভাবতই দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছেন এই ১৬ জন।     
 
ছেট বালুয়া গ্রামে জন্মগতভাবে অন্ধ ১৬ জন বংশ পরম্পরায় আত্মীয়।  ছবি: আরিফ জাহানএখন তাদের জীবিকা নির্বাহ হয় বাড়ি বাড়ি ভিক্ষে করে, মানুষের কাছে হাত পেতে। সেজন্য তারা কাকডাকা ভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। ফেরেন সন্ধ্যায়। কেউ কেউ কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করে তবেই বাড়ি ফেরেন।

আলাপ হচ্ছিল ছোট বালুয়া গ্রামের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নুরুল ইসলাম, মোশারফ হোসেনসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। তারা বাংলানিউজকে জানান, এই গ্রামে বেশ কিছু পরিবারে বংশ পরম্পরায় দৃষ্টিহীনতা আছে। কয়েকযুগ আগের কথা ধরলে পয়েশ উল্লাহ মন্ডল, তার ভাই ঘেরু মন্ডল, ছেলে তমির উদ্দিন মন্ডলের কথা আসে। তারা প্রায় কয়েক যুগ আগে মারা যান।
 
একইভাবে ঘেরু মন্ডলের ছেলে মাহির উদ্দিন মন্ডল ও মনির ‍উদ্দিন মন্ডল এবং তমির উদ্দিনের ছেলে মঙ্গলু উদ্দিনও ছিলেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। তারা মারা যান ১৯৮৭ সালের পর।
 
এই গ্রামে এখন জীবিত আছেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী আসাদ জামান মন্ডল, ইদ্রিস আলী ও তার মেয়ে আমেনা, নুরুল ইসলাম ও তার ছেলে শরিফুল ইসলাম, ইউনুস আলী এবং তার মেয়ে সাবিনা ও ফাতেমা, এজেদা বেগম, মোশারফ হোসেন, মোর্শেদা, মো. মিটুল ও তার মেয়ে মিতু, সাহেব আলী এবং তার মেয়ে শারমিন ও ছেলে শহীদ।
 
নিজেদের অন্ধত্ব নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেন সত্তরোর্ধ্ব নুরুল ইসলাম ও পঞ্চাশোর্ধ্ব মোশারফ হোসেন।

ছেট বালুয়া গ্রামে জন্মগতভাবে অন্ধ ১৬ জন বংশ পরম্পরায় আত্মীয়।  ছবি: আরিফ জাহানতারা বাংলানিউজকে জানান, ১৯৮৯ সালে তৎকালীন সরকার একাধিক দৃষ্টিশক্তিহীন ব্যক্তিকে শেরপুর উপজেলা এবিসি চক্ষু হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে রাষ্ট্রীয় খরচে তাদের ঢাকায় নেওয়া হয়। সেখান থেকে ভারতের মাদ্রাজে পাঠানো হয়। সেখানকার চিকিৎসকরা তাদের বিভিন্নভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। পরে জানানো হয়, জন্মগতভাবে দৃষ্টিশক্তিহীন বলে তাদের চিকিৎসার মাধ্যমে চোখের আলো দেওয়া সম্ভব নয়।

সেই থেকে আজ পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি আর কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি তাদের চিকিৎসা দেওয়ার ব্যাপারে এগিয়ে আসেনি।
 
এ বিষয়ে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালের উপাধ্যক্ষ ডা. রেজাউল আলম জুয়েল বাংলানিউজকে বলেন, এটা জেনেটিক সমস্যা। জন্মগতভাবে কেউ দৃষ্টিহীন হয়ে জন্মালে তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব।
 
তবে উন্নত বিশ্বে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর গবেষণা চলছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফলতাও এসেছে। এ সফলতা ব্যাপকভাবে আসতে হবে। তাহলে ব্যাপকহারে তা চিকিৎসা বিজ্ঞানে ব্যবহার করা যাবে। কেবল তখনই এ সমস্যা থেকে ধীর ধীরে উতরে ওঠা সম্ভব বলে মনে করেন ডা. রেজাউল আলম জুয়েল।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৩২১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০১৭
এমবিএইচ/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।