মাছের সন্ধানে ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দ তুলে পলই নিক্ষেপ করছে সে। কিন্তু মাছের দেখা নেই।
একটু দূরেই এই নোংরা পানিতেই কাপড়চোপড় পরিষ্কার করছিলেন দুইজন মধ্যবয়সী। তাদের একজন সোলেমান ও আরেকজন হামিদুল। জীবিকার প্রয়োজনে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছেন তারা। অভাবী হওয়ায় স্থায়ী বসবাসের জায়গা নেই তাদের।
বেঁচে থাকতে বেছে নিতে হয়েছে ভ্রাম্যমাণ জীবনযাপন পদ্ধতি। থাকার জায়গায় পানির ব্যবস্থা না থাকায় সাংসারিক কাজকর্মের জন্য নির্ভর করতে হয় এই পানির ওপর। উপায়ান্ত না পেয়ে ক্ষতির বিষয়টি জেনে-বুঝেই এ কাজটি করছেন তারা।
এককালের খরস্রোতা করতোয়া নদীর বর্তমান দৃশ্য এমনই। নদীটি বগুড়া শহরের পূর্বদিক দিয়ে বহমান। দখলবাজদের দৌরাত্মে কালের আবর্তে নিজস্ব গতিপথ হারিয়ে ফেলেছে করতোয়া। সরু হয়ে আসছে তার বিশাল বুক। ফাঁকা রয়েছে শুধুই পেটটুকু। তাও দখলে-দূষণে ভরে উঠছে। এক সময়ের জীবন্ত করতোয়া মরণের কবলে ধুঁকছে।
কলকারখানা ও পাশ দিয়ে গড়ে তোলা অবৈধ স্থাপনার বিষাক্ত বর্জ্যযুক্ত পানি এ নদীতে ফেলা হচ্ছে বিরামহীনভাবে। কিন্তু দেখার কেউ নেই। দখলদারদের কাছে সংশ্লিষ্ট সবাই যেনো জিম্মি।
কারণ, করতোয়ার হারানো যৌবন ফিরিয়ে দিতে এখনও কেউ এগিয়ে আসেননি। আগামীতে কেউ আসবেন কিনা তা নিয়েও সন্দেহ-সংশয় রয়েছে যথেষ্ট।
তবে ‘বেলা’ নামে একটি পরিবেশবাদী সংগঠন এই নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে ২০১৫ সালের জুনে বগুড়া ও গাইবান্ধার জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট ২০ জনকে বিবাদী করে হাইকোর্টে রিট করে। পরে শুনানি শেষে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে হাইকোর্ট আদেশ দেন।
উচ্চ আদালতের নির্দেশে একই বছরের জুলাইয়ে জেলা প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে ছয়জন ব্যক্তির গড়ে তোলা অবৈধ স্থাপনা ভেঙে দেয়। এরপর সেই উচ্ছেদ অভিযান আর এগোয়নি।
এদিকে, করতোয়াকে অবৈধ দখলদারদের কবল থেকে বাঁচাতে দুই যুগের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন অন্দোলন করে আসছে। কিন্তু দখলমুক্ত করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন কোনো কার্যকরী উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।
বগুড়া জেলা প্রশাসন এ পর্যন্ত প্রায় ২৮ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অবৈধ দখলদার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এরমধ্যে ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ (টিএমএসএস) ও ডায়াবেটিক হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
শুধু পৌর এলাকায় অবৈধ দখলদারদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে গাইবান্ধা জেলায় কতোজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান করতোয়া নদী অবৈধভাবে দখল করে স্থায়ী ও অস্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করেছে, এর কোনো হিসেবে নেই।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বগুড়া জেলা শাখার সভাপতি ডা. সামির হোসেন মিশু বাংলানিউজকে জানান, পরিবেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দৃষ্টি দিয়ে পরিবেশ রক্ষায় ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। করতোয়া নদী রক্ষায় সবাইকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে।
নদীটি অবৈধ দখলমুক্ত ও স্বাভাবিক পানি প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগী হতে হবে। নইলে এ সমস্যার সমাধান আদৌ সম্ভব নয় বলেও যোগ করেন তিনি। এছাড়া বিষয়টি নিয়ে তারা প্রশাসনসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময়সহ নানা কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন।
বগুড়া সদর আসনের সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম ওমর বাংলানিউজকে বলেন, করতোয়া নদী দখলমুক্ত করতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। সেই নির্দেশনা বাস্তবায়নে কাজ করা হচ্ছে। তবে অবৈধ দখলদাররা আদালতে মামলা ঠুকে দেওয়ায় কিছুটা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।
এ নিয়ে সুযোগ পেলেই তিনি সংসদে কথা বলেন। পাশাপাশি গণমাধ্যমকর্মীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে সমস্যা সমাধানকল্পে বিভিন্ন সময় মতবিনিময় করে করেন বলেও জানান তিনি।
বগুড়া জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. আশরাফ উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মেনে একাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। বাকিগুলো নিয়ে আদালতে মামলা থাকায় উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না। মামলা নিষ্পত্তি হওয়ামাত্র সেগুলো উচ্ছেদ করা হবে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১২১৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৭
এমবিএইচ/এসএনএস