তিনি বলেন, ‘যদি সবাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, তবে তা ব্যালেন্সড হয়ে যায়। এবং যদি যোগ্য প্রার্থীরা অংশ নেন, তবে ভোটাররাই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারেন।
বুধবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) দায়িত্ব গ্রহণের পর বৃহস্পতিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে প্রথম বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকের আগে সকাল ৭টা থেকে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) আসতে শুরু করেন নির্বাচন কমিশনাররা। ৮টার দিকে তারা সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ফের ইসিতে আসেন। ইসি’র সচিব মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ’র সভাপতিত্বে দুপুর ১২টার দিকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় বৈঠকে মিলিত হন কেএম নুরুল হুদার কমিশন।
সূত্র জানিয়েছে, বৈঠকে সতর্ক করে দিয়ে কে এম নুরুল হুদা কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমরা সকল কমিশনার একমত হয়েছি। নির্বাচনে জিরো টলারেন্স বজায় রাখতে কাউকে রেহাই দেবো না। এজন্য কমিশনের ওপর অর্পিত ক্ষমতা প্রয়োগ করবো’।
বৈঠকের শুরুতে ইসি’র কর্মকর্তারা এবং পরে নির্বাচন কমিশনাররা বক্তব্য দেন। বেলা দেড়টার দিকে সচিব আব্দুল্লাহ ধন্যবাদ দিয়ে বৈঠকের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
সিইসি বৈঠকে বলেন, ‘বহুদিন থেকে মাঠ পর্যায়ে কাজ করে আসা নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের আন্তরিকতা দেখেছি। সে আঙ্গিকে ইসি’র যে দক্ষ জনবল আছে, তাতে বাংলাদেশে একটি ভালো নির্বাচন উপহার দেওয়া সম্ভব হবে। শুধু একটি নয়, সামনে যেসব নির্বাচন আসবে, সেগুলোও দৃঢতার সঙ্গে মোকাবেলা করবো’।
‘সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমরা কাজ করতে বদ্ধপরিকর। আমরা যারা কমিশনার হিসেবে যোগদান করেছি, শপথ নিয়েছি, আমাদের একটাই কথা- দল-মত নির্বিশেষে সব কিছুর ঊর্ধ্বে থেকে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবো। সাংবিধানিকভাবে যে দায়িত্ব আমাদের ওপর অর্পিত হয়েছে, সে দায়িত্ব পালন করতে আমরা বদ্ধপরিকর। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে, নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করবো এবং জিরো টলারেন্সে থাকবো’।
‘নির্বাচন যেগুলো হবে, কর্মকর্তাদের কাছে আমাদের অনুরোধ, যদি কোনো ব্যত্যয় হয়ে থাকে, তবে মাঠ কর্মকর্তারা অথবা ইসি’র হাতে যে ক্ষমতা আছে, তা দিয়ে মোকাবেল করবো। কাউকে কোনো পর্যায়েই রেহাই দেওয়া হবে না’।
সিইসি বলেন, ‘একত্রে আমরা নির্বাচন কমিশনাররা প্রাইভেটলি যে আলোচনা করেছি, তাতেও আমরা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতার সঙ্গে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করবো বলে একমত, আশ্বস্ত হয়েছি। কেননা, পৃথিবীর সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, হাইকমিশনগুলো তাকিয়ে আছে। আশ করি, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে পারবো’।
সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত ইসি’র অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলীর প্রশংসা করে নুরুল হুদা বলেন, ‘আগে জেসমিন টুলী থেকে শুরু করতে চাই। তিনি যখন ২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন একেবারে নিরপেক্ষতার সঙ্গে, দৃঢতার সঙ্গে, প্রত্যয়ের সঙ্গে পরিচালনা করে সাফল্যের সঙ্গে একটি নির্বাচন উপহার দিলেন, তখন দেশবাসী তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। সমস্ত মানুষ এদেশের, তারা বলেছিলেন, কিভাবে সম্ভব? তাকে কিন্তু কেউ প্রভাবিত করতে পারেননি। অথবা তার সিদ্ধান্ত থেকে কোনো রকম কেউ বিব্রত বা বিচলিত করতে পারেননি’।
‘ইসি’র দক্ষ সচিবালয় ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের যে সক্ষমতা আছে, এ ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ থাকার কোনো কারণ নেই। কেননা, এই বাংলাদেশ কতোগুলো অত্যন্ত সাকসেসফুল নির্বাচন উপহার দিয়েছেন ইসি’র কর্মকর্তারা। যে নির্বাচনগুলো বিতর্কিত ছিল, তা কেন বিতর্কিত ছিল, তা বিশ্লেষণে আমি যাবো না। একটি কথাই বলতে পারি, আপনারা অনেকেই বলেছেন, যে ইনক্লুসিভ (অংশগ্রহণমূলক) নির্বাচন ছিল না বলেই তা বিতর্কিত ছিল’।
‘সৌভাগ্যের বিষয় হলো যে, এখন বিভিন্ন সুশীল সমাজ, মিডিয়া উপলব্ধি করছে, তারা প্রায়ই বলে- শুধুমাত্র নির্বাচন কমিশনের ওপরে দায়িত্ব চাপিয়ে দিলে সম্ভব নয়। কেননা, স্টেকহোল্ডার যারা আছে, তারা যদি সহযোগিতা না করে, অংশগ্রহণ না করে, নির্বাচন যদি প্রতিযোগিতামূলক না হয়, যদি সকল দলের অংশগ্রহণে সুসংগঠিত না হয়, সেক্ষেত্রে নির্বাচন বিতর্কিত হবেই’।
নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার ভারতের নির্বাচন কমিশনের উল্লেখ করে বলেন, ‘সুকুমার সেনকে জওহর লাল নেহেরু ডেকে বললেন, আপনি ভারতের নির্বাচন কমিশনার হবেন। তিনি বললেন, আমাকে আপনি যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেন, তাহলে আমি অবশ্যই ভারতের (তখন প্রধান ছিল না) নির্বাচন কমিশনার হবো। সুকুমার সেন নির্বাচন করলেন, নির্বাচনে তথনকার অনেক বাঘা বাঘা নেতা পরাজিত হলেন’।
‘১৯৪৭ সাল পরবর্তী স্বাধীন ভারতে সুকুমার সেনের নির্বাচনে কংগ্রেসের যারা নামকরা নেতা, তারা ধরাশায়ী হয়ে যাচ্ছেন, বিষয়টি সবার কাছে খুব একটা আনন্দময় ছিল না। তবে তখনকার মতো সেটি বিতর্কিতও ছিল না’।
তিনি বলেন, ‘সুকুমার সেন ভারতের প্রথম পদ্মভূষণ উপাধি পেয়েছেন। আরেকজনের কথা সবাই জানেন, টিএন সেশন। এ দুজনের নাম উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে, উভয়েই আমলা ছিলেন। আজকে মিডিয়াতে দেখা যায়, এই নির্বাচন কমিশন হয়েছে শুধু আমলাদের দ্বারা।
‘আমি মনে মনে ভাবি যে, সুকুমার সেন ও টিএন সেশন আমলা ছিলেন এবং আমলা হিসেবেই তারা তাদের যোগ্যতার প্রমাণ করেছেন। তারা ভারতের মতো এতো বড় বৃহত্তর একটা গণতান্ত্রিক দেশে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন। সেজন্য আমি যখন ভাবি আমিও একজন আমলা ছিলাম, তখন তাদের কথা ভেবে অত্যন্ত গৌরব অনুভব করি’।
তিনি আরো বলেন, ‘সিইসি’র নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনার ও কর্মকর্তাদের সম্মিলিত প্রায়াসে আগামী দিনগুলোকে উজ্জ্বল করে তুলব। আমাদের কাছে দেশবাসীর যে প্রত্যাশা, তা আমরা পূরণ করবো’।
‘শপথ গ্রহণের সময় প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন, সমগ্র পৃথিবীর দৃষ্টি এখন আমাদের দিকে। কেবল বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ নয়, পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ বাংলাদেশের নির্বাচনের দিকে বিশেষ করে আগামী জাতীয় নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছেন’।
নির্বাচন কমিশনার ব্রি. জে. (অব.) শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘নির্বাচনের অনিয়মের বিষয়ে আমরা জিরো টলারেন্স রজায় রাখবো। এজন্য সকলের সহযোগিতা দরকার’।
নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম ও বেগম কবিতা খানমও সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সকলের সহযোগিতার কথা বলেন।
বর্তমান কমিশনের মেয়াদ হবে ২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। এ সময়ের মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়াও প্রায় ৬০ হাজারের মতো স্থানীয় নির্বাচন সম্পন্ন করবে নুরুল হুদা কমিশন। দেশের দ্বাদশ কমিশন হিসেবে গত ০৬ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ তাদের নিয়োগ দেন। এরপর বুধবার শপথ নিয়ে ওইদিন বিকেলেই কাজে যোগ দেন তারা।
বাংলাদেশ সময়: ১৮০৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৭
ইইউডি/এএসআর