কথাগুলো বলছিল বিডিআর হত্যাযজ্ঞের শহীদ মেজর মিজানুর রহমানের বড় ছেলে তাহসি রহমান রনি (১৫)।
শনিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর বনানী সামরিক কবরস্থানে ছোট ভাই ফারদিন রহমান সামিকে (৮) নিয়ে বাবার কবরে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছে রনি।
এ হত্যাযজ্ঞের নয় মাস আগে তাদের মা রোকেয়া ফারহানা রোজি ব্রেইন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বাবা-মা হারানো এই দুই শিশু সন্তানের আশ্রয় এখন গুলশানের নানা বাড়ি। নানা ও দাদীকে সঙ্গে নিয়ে বাবার কবরে আসে দুই ভাই।
ইংলিশ মিডিয়ামের ‘এ লেভেলে’ পড়ুয়া রনি বলে, ‘বাবা মারা যাওয়ার ৯ মাস আগে মাকে হারিয়েছি। বাবাকেও হারালাম। স্কুলে বন্ধুদেরকে আমি বাবা-মায়ের কোনো গল্প বলতে পারি না। খুব খারাপ লাগে’।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারির স্মৃতিচারণ করে রানা বলে, ‘দিনটি ছিল শুক্রবার। সেদিন সকালে বাবার সঙ্গে কোনো একটি কারণে ঝগড়া হয়েছিল। বাবা নাস্তা করতে ডাকছিলেন, কিন্তু আমি বলেছিলাম, নাস্তা করবো না। সেদিন সকালে বাবা রেডি হলেন, নতুন পোশাক পড়েছেন। তখন বাবা আনঅফিসিয়ালি লে. কর্নেলে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। সেদিন ৠাংক পাওয়ার কথা ছিল’।
‘পরে কি মনে হল, বাবার সঙ্গে নাস্তা করলাম। তিনি বের হয়ে গেলেন, আর ফিরলেন না। মাকে হারানোর পর বাবাই ছিলেন আমাদের সব। কিন্তু বাবাকেও হারানোর পর আজ আট বছর আমরা একা’।
‘একটি মানুষ আমার বাবার ক্ষতি করলেন, কিন্তু কেন করলেন? এটি জানার অধিকারটুকুও কি আমার নেই? বাবা শহীদ হলেন, কিন্তু কেন হলেন, এটি জানার ইচ্ছা আছে আমার’।
রনির দাদী কোহিনুর বেগম বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। বড় নাতির কাঁধে ভর করে ছেলের কবরের কাছে এসেছেন। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
তিনি বলেন, ‘ছেলেটা মারা গেলো আট বছর হয়ে গেল। এতোদিনে সরকার আমাদেরকে অনেক কিছুই দিয়েছে। চোখের পানি কি আর টাকা দিয়ে কেনা যায়? ছেলের হত্যাকারীদের বিচার দ্রুত কার্যকর চাই’।
এভাবেই শহীদদের স্বজনদের চোখের জলে ভারি হয়ে ওঠে বনানী কবরস্থানের পরিবেশ। কেউ কেউ অনেক কষ্টে চোখের জল আটকাতে পারলেও হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, সেটা তাদের কথায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
শহীদ কর্নেল কুদরত-ই এলাহীর কবরে শ্রদ্ধা জানিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বের হচ্ছিলেন বাবা হাবীবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এখন এ বয়সে এসে এতো কষ্ট সহ্য হয় না। চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে। হত্যাকারীদের চূড়ান্ত বিচারের জানি না কী হবে? এখনো আদালত সময় দিচ্ছেন, কিন্তু শেষ হচ্ছে না। আমরা আল্লাহর বিচার চাই, আর কারো বিচার চাই না’।
সেদিনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘যখন গোলাগুলি শুরু হয়েছে, তখন ছেলেটার সঙ্গে কথা বলার অনেক চেষ্টা করেছি। সম্ভবত তার মোবাইলটা কেড়ে নিয়েছিল। ছেলেটির সঙ্গে শেষবারের মতো একটু কথাও বলতে পারিনি সেদিন’।
পিলখানায় সেদিনের নৃশংসতায় বড় ভাই কর্নেল কিবরিয়াকে হারিয়েছেন জিএসএম জাফরুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘আট বছর ধরে চাপা কষ্ট বুকে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই। সরকারের বিচার ব্যবস্থা এ ঘটনার নেপথ্যের কারণ ও ইন্ধনদাতাদের খুঁজে বের করুক’।
‘জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই, যেন ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর না ঘটে। শহীদ পরিবারের কান্না যেন জাতিকে আর না দেখতে হয়’।
শহীদ কর্নেল কাজী এমদাদুল হকের বড় ভাই কাজী হারুনুর রশীদ বলেন, ‘যারা সেদিনের ঘটনার নেপথ্যে ছিলেন, তারা এখনো আড়ালেই রয়ে গেছেন। আমরা সকল দোষীদের দ্রুত বিচার চাই’।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৭
পিএম/এএসআর