ডাস্টবিনবিহীন নগরের ৩০টি ওয়ার্ডে যত্রতত্র ফেলে রাখা ময়লা-আবর্জনা খোলা ট্রাকে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বর্জ্য ডাম্পিং করার জন্য নির্ধারিত স্থানে। কিন্তু ডাম্পিং গ্রাউন্ডটির অবস্থান আবাসিক এলাকার মধ্যে।
ডাম্পিং গ্রাউন্ডটি আবাসিক এলাকার মধ্যে হওয়ায় এর আশপাশে বসবাসকারী নাগরিকরা পড়েছেন মহা বিপাকে। ময়লা-আবর্জনার পুঁতিগন্ধে ঘনবসতিপূর্ণ ওই এলাকার পরিবেশ ক্রমেই বিষাক্ত হয়ে উঠছে। এর ফলে এলাকার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন নানান রোগে।
বাধ্য হয়েই অনেকে বাড়ি-ঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। তারা খুঁজছেন জমির ক্রেতা। আবর্জনার দুর্গন্ধের শিকার হওয়া এলাকাবাসী চাইছেন যে করেই হোক ডাম্পিং কার্যক্রমটি আবাসিক এলাকা থেকে যেন অবিলম্বে দূরে সরিয়ে নেয়া হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মোসলেম উদ্দিন তালুকদার বাংলানিউজকে জানান, ‘স্থায়ীভাবে বর্জ্য ডাম্পিং করার জন্য শহরের পুরানপাড়া, হোসনাবাদ, কাউনিয়া ও সাপানিয়া-- এই ৪টি এলাকার ৬ একর জমি অধিগ্রহণ করে বরিশাল সিটি কর্পোরেশন। এরপর একযুগের বেশি সময় ধরে বরিশাল নগরের গৃহস্থালি ও ক্লিনিক্যালসহ সব ধরনের বর্জ্য ডাম্পিং করা হয়ে থাকে এখানে। অথচ ডাম্পিং গ্রাউন্ডটির চারপাশে নেই কোনো সীমানাপ্রাচীর। নেই কোনো আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। পরিবেশ ও বাসিন্দাদের দিকে খেয়াল না রেখেই একতরফাভাবে সিটি কর্পোরেশন যেমন ময়লা ফেলে যাচ্ছে, তেমনি আবার বর্তমান সময়ে খোলা আকাশের নীচেই দাহ্য পদার্থ দিয়ে পোড়ানো হচ্ছে সেসব বর্জ্য। এতে সৃষ্ট বিষাক্ত ধোঁয়া বাতাসের সাথে মিশে ছড়িয়ে যাচ্ছে আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। পাশাপাশির ময়লার উৎকট দুর্গন্ধে আশপাশের শতশত পরিবারের পক্ষে সেখানে টেকাই দায়। ‘
স্থানীয় যুবক রিপন হাওলাদার জানান, ‘ধোঁয়া ও দুর্গন্ধের কারণে এই এলাকায় পরিবেশ বর্তমানে এমন অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছে যে, ঘরের ভেতরিও নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আমাদের বাড়ির সবাই এরই মধ্যে শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভূগছে। অনেকে ইনহেলার ব্যবহারও শুরু করেছে। এছাড়াও বাড়ির চারিপাশে কিছু গাছপালা ছিলো। সেগুলোও এখন কেমন যেন মরে যাচ্ছে। ‘
তিনি বলেন, ‘ময়লা-খোলার ভেতরেই একটি ঘর রয়েছে, যেখানে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ময়লা পোড়ানো যায়, কিন্তু সেটি নষ্ট থাকায় এখন তো কেরোসিন পেট্রোল দিয়ে খোলা জায়গায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে। এতে দিনরাত আশপাশের এলাকা ধোঁয়াচ্ছন্ন থাকে। ‘
হোসনে আরা নামে এক নারী জানান, খোলা জায়গায় ময়লা ফেলায় এর পাশে থাকা ফসলি জমিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বর্ষার সময়ে পানি উঠলে পুরো এলাকায় ময়লা-খোলার ময়লা ছড়িয়ে পড়ে। আর মানুষ নানান রোগে আক্রান্ত হয়।
স্থানীয় ব্যবসায়ী মাসুদ জানান, নগরের ৩০টি ওয়ার্ডের ময়লা ফেলতে ফেলতে এখন কাউনিয়া সংলগ্ন এই এলাকার নাম ময়লা-খোলা হয়ে গেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এখানকার মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে যাচ্ছে। বছর দুই আগে অবসরপ্রাপ্ত এক ব্যাংক কর্মকর্তা তার ‘শান্তি নীড়’ নামের বাড়িটিতে তালা ঝুলিয়ে চলে গেছেন। এরকম অনেক পরিবার রয়েছে যারা আবর্জনার উৎকট গন্ধ আর তীব্র বাযুদূষণ থেকে বাঁচতে এলাকাছেঁড়ে চলে যাচ্ছেন।
আশপাশের মানুষের অসুখ-বিসুখ লেগে রয়েছে। ময়লাখোলার পাশের রাস্তাগুলো দিয়ে নাক চেপে, চোখ ঢেকে স্কুলের শিক্ষার্থীসহ শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকলকে চলাফেরা করতে হয়। তিনি জানান, নগরের বেশিরভাগ জায়গার জমির দাম বাড়লেও ময়লাখোলার আশপাশের জায়গার দাম দিনে দিনে কমছে। কারণ এখানে কেউ আসতে চায় না।
বিসিসি’র পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা দীপক লাল মৃধা বলেন, ‘তাদের ১২ থেকে ১৪টি গাড়ি প্রতিদিন নগরের ৩০টি ওয়ার্ড থেকে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য ডাম্পিং স্পটে নিয়ে যায়। সেখানে এগুলোকে ফেলার পর বাছাই রও আলাদা করা সহ নানান কাজ করতে হয়। এতে স্থানীয় মানুষজন যে কষ্ট পাচ্ছেন একথা সত্য। কিন্তু এই মুহূর্তে কিছুই করার নেই কর্পোরেশনের। তবে সময়ের সাথে সাথে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে। ‘
ময়লাখোলার কারণে জনগণের ভোগান্তির কথা স্বীকার করে কর্পোরেশনের মেয়র আহসান হাবিব কামাল বলেন, ‘জায়গার সংকটের কারনে ডাম্পিং স্থানটি সরানো সম্ভব হচ্ছে না। তবে বিষয়টি নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা রয়েছে। ‘
পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আরেফিন বাদল বাংলানিউজকে বলেন, ‘সিটি কর্পোরেশনকে একটা নির্দিষ্ট নীতিমালায় ওই স্থানে ময়লাফেলার অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু তারা তা না মেনে যদি পরিবেশের ক্ষতি করে তবে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে আইন পদক্ষেপ নেয়া যাবে। এজন্য ডাম্পিং প্লেসের সার্বিক কার্যক্রম মনিটরিং করা হবে। ‘
এধরনের ময়লা পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট ধোঁয়ারা কারণে কার্বন, কার্বনডাই অক্সাইড, সীসাসহ নানান বিষাক্তদ্রব্য বাতাসের সাথে মিশে যায়। এই ধোয়ায় শিশু এবং বৃদ্ধদের বেশি ক্ষতি হয় বলে জানিয়েছেন বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ ভাস্কর সাহা।
তিনি আরো বলেন, এখানকার মানুষের শ্বাসকষ্টসহ নানান কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি খুবই বেশি। ডাম্পিং কার্যক্রমটি তাই আবাসিক এলাকা থেকে জনশূন্য এলাকায় অবিলম্বে সরিয়ে নেয়া উচিত।
বাংলাদেশ সময়: ১২২৮ ঘন্টা, মার্চ ০৮, ২০১৭
এমএস/জেএম