একাধারে তিনি ছিলেন ঝানু কূটনীতিক, দেশপ্রেমিক, সাহিত্য-সঙ্গীত ও চিত্রকলার সমঝদার, শিল্পসংগ্রাহক, নানা গুণে গুণান্বিত এক সুসংস্কৃত ব্যক্তি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও রাষ্ট্রদূতরা এভাবেই তার মূল্যায়ন করেন্।
মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শমসের মবিন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, মিজারুল কায়েস ছিলেন অত্যন্ত সংবেদনশীল এক সজ্জন ব্যক্তি। সেই সঙ্গে ছিলেন এক দক্ষ, পেশাদার কূটনীতিক। কাজের বিষয়ে কোনো দিন কোনোও অবহেলা ছিল না তার। ছিলেন সর্বার্থে এক দেশপ্রেমিক। আমি তার মৃত্যুতে শোকাহত, মর্মাহত। দীর্ঘদিনের চাকুরি জীবন তো বটেই, এর বাইরেও তাকে আমি চিনতাম। নি:সন্দেহে বাংলাদেশ একজন নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা ও সত্যিকার দেশপ্রেমিককে হারিয়েছে।
শমসের মবিন চৌধুরী যোগ করেন, সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে মিজারুলের আগ্রহ ও অনুরাগ বিস্তৃত ছিল। চিত্রকলা, কবিতা, সঙ্গীতসহ মানববিদ্যার নানা ক্ষেত্রে তার অভিনিবেশ ছিল ঈর্ষণীয়। নিজে গাইতেনও। সেকথা জানেন তার ঘনিষ্টজনেরা।
একইসঙ্গে মিজারুল একজন ভালো শিল্পসংগ্রাহকও ছিলেন। সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে মিজারুলের যে প্রবল অনুরাগ ও আগ্রহ ছিল, সে বিষয়ে আমরা সবাই কমবেশি অবগত। তার মৃত্যুতে অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি হবে।
মিজারুল কায়েসের খ্যাদ্যপ্রীতি ও রসনাবিলাসের প্রসঙ্গ টেনে শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, মিজারুলের রসনাবিলাস সম্পর্কে তার জেষ্ঠ্য সহকর্মী হিসেবে নয়, বড় ভাই হিসেবে তাকে আমি বারবার বলতাম, তুমি যদি খাওয়া দাওয়া না কমাও তাহলে ক্ষতি হবে। তাকে ভোজনরসিক বললেও কম বলা হবে। তিনি খেতে ও খাওয়াতেও খুব পছন্দ করতেন। কখনও বাছবিচার করতেন না। এই ভোজনবিলাস যে তার জন্য ভবিষ্যতে ক্ষতি বয়ে আনতে পারে, সে বিষয়ে আমি অকপটে তাকে সতর্ক করতে দ্বিধাবোধ করিনি। পরে আমি জেনেছিলাম, খাদ্যবিলাস তিনি আর ত্যাগ করতে পারেননি। খাবার গ্রহণে নিজের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ ছিল না। যদিও এটা ছিল তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়।
মিজারুল কায়েসকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত সি এম শফি সামি। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, আমি মিজারুলকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যোগদানের দিন থেকেই চিনতাম। তিনি যখন যোগ দেন তখন আমি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া উইং-এর মহাপরিচালক হিসেবে কাজ করছিলাম। তখন তিনি আমার অধীনেই প্রথম যোগ দেন। মিজারুল ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, সর্বার্থে দেশপ্রেমিক, দক্ষ কর্মকর্তা ও সুযোগ্য কূটনীতিক। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি উত্তরোত্তর দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন। আমি মনে করি, বাংলাদেশের কূটনৈতিক ক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল নাম ছিলেন। আমি মর্মাহত। দেশ একজন প্রতিভাবান কূটনীতিককে হারিয়েছে।
মিজারুল ছিলেন অত্যন্ত সাহিত্যপ্রেমিক। তিনি নিজেকে সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে সক্রিয় ও ব্যাপৃত রাখতেন। আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে চাই বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-কৃষ্টির উজ্জ্বলতাকে ছড়িয়ে দিতে তার ছিল অসীম উৎসাহ। এক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির বাংলানিউজকে বলেন, মিজারুল অত্যন্ত ভালো লোক ছিলেন। মিজারুল গুরুত্বের সঙ্গে বিশেষ করে কৃষ্টির সঙ্গে কূটনীতির যে একটা মেলবন্ধন রয়েছে, কূটনীতিতে কৃষ্টিকে মিশিয়ে বহির্বিশ্বে কীভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জল করা যায় সে বিষয়ে ছিলেন সদা সচেষ্ট। তিনি পররাষ্ট্রসচিবের দায়িত্ব পালন শেষে হাইকমিশনার হিসেবে লন্ডনে যান। বহির্বিবিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য তিনি সেখানে বাংলাদেশের সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতিকে তুলে ধরেন।
মোহাম্মদ জমিরও তার খাদ্যপ্রীতির প্রসঙ্গটির উল্লেখ করে বলেন, হরেক রকম দেশি-বিদেশি সুখাদ্যের প্রতি তার তীব্র আকর্ষণ ছিল। খাদ্য সম্পর্কে বিবেচনা, আলোচনা এবং বিভিন্ন রকম খারারের রেসিপি সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিলো অতুলনীয়। খাদ্য নিয়ে বিভিন্ন সময় আমার সঙ্গে তার আলাপ হত। আমি অবশ্য তার অতিভোজনপ্রিয়তার বিষয়ে বেশ কয়েকবার সচেতনও করেছি। তবে আমার ধারণা, এ কারণেই তার ওজন বেড়ে গিয়েছিল। তবে তার স্বাস্থ্যগত বিপর্যয়ের পেছনে অন্য কোনো সমস্যা থাকাও বিচিত্র নয়। তার অকাল মৃত্যু আমাকে ব্যথিত, মর্মাহত করেছে। তার চলে যাওয়ার ক্ষতি সহজে পূরণ হবার নয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৭ ঘণ্টা, মার্চ ১১, ২০১৭
কেজেড/জেএম